একজন কৃষক আছেন, যিনি জমিতে চাষ করেন কিন্তু মাটি কর্ষণ করেন না, সার ব্যবহার করেন না, কীটনাশক দেন না— কেবল প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ মেনেই চাষাবাদ চালিয়ে যান। শুনতে অবাক লাগলেও, মাসানোবু ফুকুওকার কৃষি দর্শন ছিল ঠিক এমনই। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি নিজেই জানে কীভাবে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, আর মানুষের অযথা হস্তক্ষেপই বরং প্রকৃতির ক্ষতি করে। এই ভাবনা থেকেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন “প্রাকৃতিক চাষ” বা “ন্যাচারাল ফার্মিং” পদ্ধতি, যা আধুনিক কৃষির প্রচলিত নিয়ম-কানুনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক নতুন বিপ্লবের সম্ভাবনার জন্ম দেয়।
১৯১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, জাপানের এহিমে অঞ্চলের ইয়ো শহরে জন্মগ্রহণ করেন ফুকুওকা। তার পরিবার ছিল সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সচ্ছল। ছোটবেলা থেকেই তার পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল, বিশেষত কৃষি ও উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি। গিফু কৃষি কলেজে পড়াশোনা করে তিনি অণুজীববিজ্ঞান ও উদ্ভিদ রোগবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর ইয়োকোহামা কাস্টমস ব্যুরোতে উদ্ভিদ পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু এখানেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় এক আকস্মিক ঘটনায়।
১৯৩৭ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটানোর সময় ফুকুওকা গভীর এক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, প্রকৃতি আসলে মানুষের সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে; বরং মানুষের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপই প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর। এই উপলব্ধি তার চিন্তাজগতে এত গভীর ছাপ ফেলে যে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন পারিবারিক খামারে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নতুন কৃষি পদ্ধতির সন্ধান।
ফুকুওকার লক্ষ্য ছিল প্রচলিত কৃষি-ধারণাকে ভেঙে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দকে অনুসরণ করা। তিনি দেখতে পান, প্রকৃতিতে গাছপালা নিজের মতো করে বেড়ে ওঠে, কোনো বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অথচ আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক আর মাটির গভীর কর্ষণ মাটির স্বাভাবিক শক্তিকে ধ্বংস করে। এসব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি তৈরি করেন তার ‘প্রাকৃতিক চাষের’ চারটি মৌলিক নীতি—
১) মাটি কর্ষণ নিষিদ্ধ,
২) রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ,
৩) আগাছা দমন নয়, সহাবস্থান,
৪) শস্যের প্রাকৃতিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি না করা।
তার এই পদ্ধতিতে ধান, যবসহ নানা ফসল চাষ হত, অথচ প্রচলিত কৃষির তুলনায় এতে শ্রম ও খরচ ছিল অতি সামান্য। প্রকৃতি নিজেই ভারসাম্য বজায় রাখে, মানুষের কাজ কেবল তার ছন্দকে সম্মান করা। ফুকুওকা এভাবেই কৃষির বাইরেও প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক, জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়েও তার চিন্তাভাবনাকে বিস্তৃত করতে থাকেন।
১৯৪৭ সালে তার প্রথম বই “কামি নো কাকুমেই” প্রকাশিত হলেও, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত “দি ওয়ান স্ট্র রেভোলিউশন” বইটি তাকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়। এই বইতে তিনি দেখান, কীভাবে প্রকৃতির ছন্দ মেনে কৃষকরা বিনা রাসায়নিক ব্যবহারে কৃষিকাজ করতে পারে, কম পরিশ্রমে বেশি ফল পেতে পারে। তার এই দর্শন কৃষক, পরিবেশবাদী, দার্শনিক ও সাধারণ মানুষ— সকলের কাছেই এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
১৯৭৯ সালে মাসানোবু ফুকুওকা বিশ্বভ্রমণ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশে গিয়ে তিনি তার ভাবনার বীজ ছড়িয়ে দেন। সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মরুভূমিতে গিয়ে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বীজ ছড়িয়ে মরুকরণ রোধের চেষ্টা করেন। ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ব্রাজিলসহ বহু দেশে তার পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু হয়।
তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ১৯৮৮ সালে তিনি এশিয়ার নোবেল খ্যাত রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯৭ সালে তিনি আর্থ কাউন্সিল পুরস্কার পান পরিবেশগত টেকসই কৃষিতে যুগান্তকারী ভূমিকার জন্য।
২০০৮ সালের ১৬ আগস্ট, ৯৫ বছর বয়সে মাসানোবু ফুকুওকা মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার “প্রাকৃতিক চাষ” আজও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে— পরিবেশবান্ধব কৃষির বিকল্প মডেল হয়ে। তার দর্শন আমাদের আজও শেখায়: প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মিলেমিশে চললেই টেকসই কৃষি সম্ভব।
মাসানোবু ফুকুওকা শুধু একজন কৃষিবিজ্ঞানী ছিলেন না; তিনি প্রকৃতির এক নিরব দর্শক, প্রকৃতি-বিশ্বাসী দার্শনিক। তার “প্রাকৃতিক চাষ” কেবল জমিতে চাষের পদ্ধতি নয়, বরং এটি প্রকৃতিকে বোঝার, সম্মান করার এবং কম হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রকৃতির গভীরতর আইন মেনে জীবনযাপনের এক অনন্য দর্শন। তার ভাবনা এবং কর্ম আজও অনাগত দিনগুলিতে কৃষক, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে থেকে যাবে— নতুন পৃথিবীর টেকসই যাত্রার জন্য।