ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের যখন উত্তেজনার পারদ চড়ে, তখন শুধু সীমান্তের গোলাগুলিই নয়, শুরু হয় আরেক যুদ্ধ – তথ্যের যুদ্ধ। সম্প্রতি দুই দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এই তথ্যযুদ্ধ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিজওয়ান-উল-আলম তাঁর “ভারত–পাকিস্তান: যুদ্ধে সবার আগে জেতে মিথ্যা” কলামে এই বিষয়টিই তুলে ধরে বলেছেন-
একটা পুরোনো কথা আছে, যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম যে জিনিসটা মারা যায়, তা হলো ‘সত্য’। যুদ্ধ মানেই মিথ্যে খবরের ছড়াছড়ি আর সত্যকে চাপা দেওয়া। বাস্তব যুদ্ধের আগেই শুরু হয়ে যায় খবরের যুদ্ধ, আর সেখানেই নির্ধারিত হয় জয়-পরাজয়। যারা এই খবরের খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই শুরুতে জিতে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন ছড়ানো হয় মিথ্যা?
যুদ্ধের সময় দেশের মানুষকে এক রাখা আর যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জোগানো সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়ে। তাই অনেক সত্য ঘটনা হয় লুকিয়ে ফেলা হয়, নয়তো ঘুরিয়ে বলা হয়। একটা জোরালো গল্প তৈরি করা হয়, যা মানুষের মনোবল বাড়ায়, যুদ্ধকে সঠিক প্রমাণ করে আর শত্রুর প্রতি ঘৃণা তৈরি করে। সরকার ও সেনাবাহিনী প্রায়শই এই কাজটা করে থাকে।
সরকার বোঝাতে চায়, দেশের ভালোর জন্যই এই যুদ্ধ দরকার। তারা শত্রুকে ভয়ংকর হিসেবে দেখায় আর নিজেদের সৈন্যদের দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে তুলে ধরে। সৈন্যদের কষ্টের কথা, যুদ্ধের বীরত্বগাথা আর শত্রুকে খারাপ, নিষ্ঠুর প্রমাণ করার চেষ্টা চলে। অনেক সময় শত্রুর দোষ বাড়িয়ে বলা হয়, এমনকি মিথ্যে খবরও ছড়ানো হয়।
এই প্রচারণা শুধু দেশের ভেতরের মানুষ বা সৈন্যদের সাহস বাড়াতেই নয়, শত্রুপক্ষের মনোবল ভাঙতেও কাজে লাগে। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন তো ছিলই, এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। পোস্টার, সিনেমা, উত্তেজক স্লোগান – সবই এর অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেমন যুদ্ধকে দেখানো হতো মজার অভিযান হিসেবে, আজও তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে ছড়িয়ে মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করা হয়।
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাতে এই তথ্যের যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দুই দেশের মানুষই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম খবর ছড়াচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। দুই দেশই চাইছে মানুষের সমর্থন তাদের দিকে থাকুক। এমন অবস্থায় আসল সত্যিটা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
রিজওয়ান-উল-আলম বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হন দুই দেশের নেতারাই। তাঁরা সরকারি মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো আবেগী বা ভুয়া খবর ব্যবহার করে মানুষের সমর্থন আদায় করেন। ‘দেশের নিরাপত্তা’ আর ‘ঐক্যের’ দোহাই দিয়ে তাঁরা নিজেদের মতো করে ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। মানুষ তখন নিজেরা চিন্তা না করে, যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করে।
যখন চারদিকে শুধু ভুল খবর, পুরোনো ভিডিও আর ভিত্তিহীন দাবি ঘুরতে থাকে, তখন আমাদের কী করা উচিত?
প্রথমে বুঝতে হবে, এটা একটা তথ্যের যুদ্ধ। সরকার বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যেকোনো আবেগী বা বড় দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখুন। যাচাই না করে কোনো কিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। গুগলে বা ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে দেখে নিন খবরটা সত্যি কি না।
সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল সত্যের চেয়ে আলোচনার জন্ম দিতে বেশি আগ্রহী। তাই সত্যিটা যাচাই করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। যা-ই দেখি বা শুনি, তা নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা দরকার। সবাই যদি সত্যিটা খোঁজার চেষ্টা করে, তাহলে ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘাত অনেকটাই কমে আসতে পারে।
শেষ কথা হল- যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রথম শিকার হয় সত্য। মিথ্যা গল্প, গুজব আর ঘৃণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত-পাকিস্তানের মতো জটিল সম্পর্কে এই তথ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। তাই আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, যাচাই করতে হবে আর গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
কারণ, সত্য ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।