আপনি কি জানেন—ইসরায়েলই ছিল বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রগুলোর একটি, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছিল?
১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ, লাখো মানুষ দিগ্বিদিক পালাচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। সেই সময়, নেপালে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে একটি চিঠি পৌঁছে যায় সদ্যগঠিত মুজিবনগর সরকারের কাছে। সেই চিঠিতে ইসরায়েল শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য অস্ত্রসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাবও করেছিল।
কিন্তু মুজিবনগর সরকারের অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট—
যে রাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা দখল করে রেখেছে, ফিলিস্তিনিদের রক্তে নদী বইয়ে দিচ্ছে, তাদের সাহায্য বা স্বীকৃতি কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ন্যায় ও মানবতার সংগ্রাম। সেখানে অন্যায়কারী রাষ্ট্রের সামান্য সম্পৃক্ততাও অগ্রহণযোগ্য ছিল।
ইসরায়েলের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা ও বাংলাদেশের অনড়তা
প্রথম প্রত্যাখ্যানের পরও, ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
তাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বা এবান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের কাছে তারবার্তা পাঠান।
কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বীকৃতির কোনো উত্তর দেননি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি তখনই স্থির হয়ে গিয়েছিল—
“দখলদার ও নিপীড়কের কাছে কৃতজ্ঞতা নয়।”
মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতি বিলম্বিত হয়
কিন্তু ইসরায়েল যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিল, মুসলিম বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ, বিশেষত সৌদি আরব ও পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি।
অনেক মুসলিম দেশ তিন বছরেরও বেশি সময় বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করেছে।
কেউ কেউ পাঁচ বছর, কেউ দশ বছর পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সৌদি আরব দীর্ঘদিন বাংলাদেশিদের হজ পালনের ক্ষেত্রেও নানা বাধা সৃষ্টি করেছিল।
এ ইতিহাস মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে আজও দগদগে হয়ে আছে।
বাংলাদেশের নীতিগত উচ্চতা
অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশ ইসরায়েলের স্বীকৃতি ও সহায়তা বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
কারণ, স্বাধীনতার এই সংগ্রাম ছিল শুধু ভূখণ্ডের নয়, আত্মার মুক্তিরও। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, দখলদার কোনো রাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা করা মুক্তিযুদ্ধের নীতিকে অপমানিত করত।
এটাই ছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানের প্রথম উচ্চারণ—
“আমরা ন্যায়ের পক্ষে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে।”
পাসপোর্টে ইসরায়েল নিষিদ্ধ—এবং পরবর্তীকালের বিতর্ক
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের ছাপানো পাসপোর্টে লেখা ছিল:
“This passport is valid for all countries of the world except Israel.”
এ ছিল বাংলাদেশের জনগণের চিন্তার প্রতিফলন।
কিন্তু ২০২১ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার বিতর্কিতভাবে পাসপোর্ট থেকে এই লাইনটি তুলে দেয়।
তারপরও বাংলাদেশের জনগণ ও মূলনীতির অবস্থান স্পষ্ট— আমরা মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ, নিপীড়কের প্রতি নয়।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ: অনমনীয় মানবতা
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম ছিল একইসাথে ন্যায়ের সংগ্রাম।
ইসরায়েলের অস্ত্র কিংবা স্বীকৃতি গ্রহণ করলে আমাদের সেই লড়াইয়ের নৈতিকতা কলঙ্কিত হতো।
ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছিল আমাদের মানবিক দায়িত্বের অংশ।
একাত্তরের দাবানল থেকে বিজয়ের প্রহর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছে এক আপসহীন, প্রতিবাদী জাতি হিসেবে।
এ কারণেই ইসরায়েল বারবার স্বীকৃতি দিলেও, আমরা দৃপ্ত কণ্ঠে সেটিকে ফিরিয়ে দিয়েছি।
ফিরিয়ে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে অম্লান রাখতে, বিশ্বব্যাপী নিপীড়িতের পক্ষে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থনকে অটুট রাখতে।
কারণ, আমরা অন্যায়কে ঘৃণা করি।
আমাদের স্বাধীনতা—মানবতার পক্ষে।