টাইমসের সাউথ এশিয়া ব্যুরো চিফ মুজিব মাশাল তার কলামে তুলে ধরেছেন ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতের এক নতুন দিক। ছয় বছর পর, কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার জের ধরে দুই দেশ আবার সংঘাতে জড়িয়েছে। মাশালের মতে এবারের পরিস্থিতি শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এমন নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রতিফলন।
পশ্চিমারা সামরিক সাহায্য দিয়ে ভারতকে শক্তিশালী করছে, অন্যদিকে চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র জুগিয়ে চলেছে। ভারতের একসময়ের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছে বড় পরিবর্তন। দেশটি এখন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে, কমিয়ে দিয়েছে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা। অথচ এই রাশিয়াই ছিল শীতল যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধান মিত্র।
বিপরীতে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব কমেছে। ফলে পাকিস্তান অস্ত্র ও সমর্থনের জন্য চীনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে। বর্তমানে তাদের অধিকাংশ সমরাস্ত্রই আসছে চীন থেকে। এই সমীকরণ বদলে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার পুরোনো শত্রুতা এক নতুন, আরও বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে।
এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নিজস্ব স্বার্থ।
যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতকে পাশে চায়। অন্যদিকে, চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগসহ অন্যান্য প্রকল্পে পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং দেশটিকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে, সীমান্তে চীন ও ভারতের মধ্যেও উত্তেজনা বাড়ছে।
এই নতুন মেরুকরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ভিন্ন। সেবার পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে দুই দেশের নেতাদের ফোন করে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল।
কিন্তু এবার, কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার পর মার্কিন প্রশাসন ভারতের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন জানিয়েছে, যা অনেক ভারতীয় কর্মকর্তার কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ‘সবুজ সংকেত’ বলে মনে হয়েছে।
শীতল যুদ্ধের সময় ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ অস্ত্র আসত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, আর পাকিস্তান ছিল মার্কিন বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এমনকি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানও পেয়েছিল।
কিন্তু ৯/১১ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়, যদিও তখনও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দিয়ে গেছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে পাকিস্তানের প্রায় ৮০% অস্ত্র এসেছে চীন থেকে। অন্যদিকে,
ভারতের ক্ষেত্রে এই সময়ে রাশিয়ার অস্ত্রের ভাগ কমে ৩৮% হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলো তার প্রধান সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান রক্ষণাবেক্ষণে বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি ৪০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি অনুমোদন করলেও, ২০১৯ সালে এই বিমান ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
সেসময় ভারতের একটি হেলিকপ্টার নিজেদের গুলিতেই ভূপাতিত হয়, যা ভারতের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মূলত এরপর থেকে ভারত সামরিক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করছে।
মুজিব মাশালের মতে, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি যেকোনো ছোট ভুল বা উসকানিকে ভয়াবহ সংঘাতে রূপ দিতে পারে।
ভারত-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ লড়াই তাই কেবল দুই দেশের থাকবে না, বরং তা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অস্ত্রে সজ্জিত দুই শিবিরের লড়াইয়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শত্রু আর মিত্রের এই পরিবর্তিত হিসাব দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।