মেরিটাল রেপ বা বৈবাহিক জীবনে অনেক যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ হতে পারে, এটা সাধারণ ভাবে আমাদের অবাক করে, এই ঘটনা কি হতে পারে? নানা গবেষণায় দেখা গেছে এটা হয়।

বাংলাদেশেও ম্যারিটাল রেপ বোঝা এবং তাকে স্বীকৃতি দেয়া এসব বিষয় নিয়ে কথা উঠলে আমারা বিতর্ক দেখি।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে এই বিষয়গুলোতে ধর্মকেও নিয়ে আসা হয়। মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় ম্যারেটাল রেইপ নিয়ে কি বলছে সেটা দেখা যাক:

ম্যারিটাল রেপ, অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্কে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক—এই বিষয়টি অনেকের কাছেই অবাক করার মতো শোনায়। অনেকেই ভাবেন, বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে ‘ধর্ষণ’ কিভাবে সম্ভব?
কিন্তু গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, এটি শুধু সম্ভবই নয়, বরং বহু নারীর জন্য এটি একটি নির্মম বাস্তবতা।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে, যখন বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, তখন তা সাধারণত নানা রকম বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ বিষয়টি শুধুই সামাজিক নয়—এটি ধর্ম, আইন এবং নারীর অধিকার সংক্রান্ত নানা সংবেদনশীল প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করলে ধর্মের ব্যাখ্যা ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে নানা দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হতে হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম বিশ্বে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা ও চিন্তাভাবনার উদ্ভব ঘটেছে। এই গবেষণাগুলোর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের মূল শিক্ষার আলোকে—যেখানে পারস্পরিক সম্মান, প্রেম ও করুণা কেন্দ্রীয় জায়গা দখল করে—সেখানে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে বৈধতা দেয়া ইসলামি নৈতিকতার পরিপন্থী।

ইসলাম মানে শান্তি, আত্মসমর্পণ এবং করুণা। এই ধর্মের মূল ভিত্তি হলো মানবতা, ন্যায়বিচার এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। এই প্রেক্ষাপটে, একটি প্রশ্ন প্রায়শই উঠে আসে—বিশেষত যখন ভুল ধারণা ছড়ানো হয়—ইসলাম কি বিয়ের পবিত্র বন্ধনের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক বা দাম্পত্য ধর্ষণকে সমর্থন করে? উত্তরটি দ্ব্যর্থহীন এবং জোরালো—না। কুরআন, হাদিস, ইসলামের উচ্চতর উদ্দেশ্য এবং বিবেকবান আলেমদের ব্যাখ্যা—সবই এক সুরে সাক্ষ্য দেয় যে, ইসলামে জোর বা জবরদস্তির কোনো স্থান নেই, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মতো এমন একটি ঘনিষ্ঠ এবং সম্মানজনক সম্পর্কে।

বিয়ের ভিত্তি: ভালোবাসা

ইসলামে বিয়ে কেবল একটি সামাজিক বা আইনি চুক্তি নয়; এটি একটি ‘মীসাক়ান গালিযান’ বা দৃঢ় অঙ্গীকার। কুরআন মজিদে আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে বর্ণনা করেছেন ভালোবাসা (মাওয়াদ্দাহ), করুণা (রাহমাহ) এবং প্রশান্তি (সাকিনাহ)-এর উৎস হিসেবে। সূরা আর-রূম (৩০:২১)-এ বলা হয়েছে:

“আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।”

প্রশ্ন হলো, যেখানে ভিত্তিই হলো ভালোবাসা, দয়া আর প্রশান্তি, সেখানে জোর বা ভীতির স্থান কোথায়?
যে যৌন সম্পর্ক চাপ প্রয়োগ বা ভয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তা কি সঙ্গীর জন্য প্রশান্তির কারণ হতে পারে?
এটি কুরআনের বর্ণিত আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।

‘মু‘আশারাহ বিল-মা‘রূফ’
সদাচরণ ও সম্মানের নির্দেশ

কুরআন স্বামীদের নির্দেশ দেয় স্ত্রীদের সঙ্গে ‘মারূফ’ বা ন্যায়সঙ্গত ও সদাচরণের সাথে জীবনযাপন করতে। এর অর্থ শুধু ভরণপোষণ বা আশ্রয় দেওয়া নয়; এর মধ্যে স্ত্রীর অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রতি সম্মান দেখানোও অন্তর্ভুক্ত। “ইসলামিক পার্সপেক্টিভ অন ম্যারিটাল রেপ” গবেষণাপত্রে ইন্দোনেশিয়ার ইউনিভার্সিটি মুহাম্মদিয়া ইউজ্ঞাকার্তার আইন বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ এন্দ্রিয়ো সুসিলা উল্লেখ করেছেন:

— “স্ত্রী অনিচ্ছুক হলে স্বামী তাঁকে যৌনমিলনে বাধ্য করতে পারে না।”
ড. সুসিলা বলছেন, যখন একজন স্ত্রী অসুস্থতা, ক্লান্তি, মানসিক চাপ বা অন্য কোনো বৈধ কারণে যৌন মিলনে অসম্মতি জানান, তখন ‘মারূফ’ আচরণের দাবি হলো স্বামী তাকে জোর করতে পারবেন না।

ইন্দনেশিয়ার প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাসদার এফ. মাসউদি ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কেবল জৈবিক চাহিদা পূরণ বা বংশবৃদ্ধির উপায় নয়, তিবি এটিকে ‘ইবাদত’ বা উপাসনার সমতুল্য গণ্য করা হয়েছে। এটি এমন এক পবিত্র কাজ যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। কিন্তু যেকোনো ইবাদতের পূর্বশর্ত হলো বিশুদ্ধ নিয়ত এবং স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ।
এই ধারণাকে তিনি ‘আকদুল ইবাদা’ (উপাসনার চুক্তি) বলেছেন এবং জোর দিয়ে বলেছেন:

“in worship there must be no force… it should be based on voluntariness.”
— “ইবাদতে কোনো জোরজবরদস্তি নেই… এটি স্বেচ্ছায় হতে হবে।”

তিনি বলছেন, বিয়ে যেহেতু একটি ইবাদত এবং ইসলাম পরিস্কারভাবে বলে, জোর করে আদায় করা কোনো কাজ ইবাদত হতে পারে না। তাই স্ত্রীর অসম্মতিতে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন এই পবিত্র কাজটিকে তার আধ্যাত্মিক মর্যাদা থেকে নামিয়ে নিছক পাশবিক আচরণে পরিণত করে, যা ইসলাম সমর্থন করে না।

“ইসলামিক পার্সপেক্টিভ অন ম্যারিটাল রেপ” গবেষণায় ড. সুসিলা আরও বলছেন ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপরই পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব অর্পণ করেছে। যৌন ক্ষেত্রেও তাই।

“যৌনক্রিয়া উভয় পক্ষের আনন্দের জন্য। এই পারস্পরিকতার অর্থ হলো, সম্পর্কটি একতরফা দাবির উপর ভিত্তি করে নয়, বরং বোঝাপড়া ও সম্মতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। স্বামীর যেমন চাহিদা আছে, স্ত্রীরও শারীরিক ও মানসিক চাহিদা, সুস্থতা এবং অনুভূতির প্রতি মনোযোগ দেওয়ার দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তায়।”

ইসলামের একটি মৌলিক নীতি হলো “অন্যের ক্ষতি করো না এবং নিজেও ক্ষতির শিকার হয়ো না।” জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্ত্রীর জন্য কেবল শারীরিক কষ্টের কারণ হয় না, বরং তা গভীর মানসিক আঘাত সৃষ্টি করে। এটি তার আত্মমর্যাদাবোধকে আহত করে, সম্পর্কের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাস তৈরি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ট্রমা সৃষ্টি করতে পারে। ড. মুহাম্মদ এন্দ্রিয়ো সুসিলা বলছেন এই ধরনের সুস্পষ্ট ক্ষতি ইসলামী নীতিমালার সরাসরি লঙ্ঘন।

ইসলামী আইনের উচ্চতর উদ্দেশ্য পাঁচটি মৌলিক বিষয় রক্ষা করা: জীবন (নাফস), ধর্ম (দীন), সম্মান, বংশ (নাসল) এবং সম্পদ (মাল)। এর মধ্যে জীবন ও সম্মানের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জোরপূর্বক যৌনতা স্ত্রীর শারীরিক সুস্থতা (জীবন) এবং তার সম্মান ও আত্মমর্যাদা উভয়কেই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ড. হাবিবুর রহমান যেমন উল্লেখ করেছেন, মাকাসিদের উদ্দেশ্যই হলো মানবকল্যাণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষতি দূর করা। তাই মাকাসিদ আল-শরিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকেও দাম্পত্য ধর্ষণ সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য।

অনেক রক্ষণশীল ব্যাখ্যায় ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও, সমসাময়িক বহু আলেম এবং ইসলামী চিন্তাবিদ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, স্ত্রীর অসম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ইসলাম সমর্থন করে না। ইন্দোনেশিয়ার প্রখ্যাত মুফাসসির কুরাইশ শিহাবের মতো আলেমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন:

— “ধর্ষণ অবৈধ—এমনকি যদি তা কারও নিজের স্ত্রীর ওপরই সংঘটিত হয়… এমন অপরাধ হলে স্ত্রী চাইলে বিচারকের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।”

মালয়েশিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও একই সুরে বলেছেন:
“Marital rape must be considered an offence in Islamic penal understanding if it harms the wife.”
— “যদি এটি স্ত্রীর ক্ষতি করে, তবে ইসলামী ফিকাহ অনুযায়ী marital rape একটি অপরাধ।”

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া তাদের আইনে দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রেখেছে (সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড), এটি প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই ধরনের নিপীড়নমূলক আচরণকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব।

সুতরাং, কুরআন, হাদিস, ইসলামের মৌলিক নীতি, উচ্চতর উদ্দেশ্য এবং বিবেকবান আলেমদের মতামতের ভিত্তিতে এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম দাম্পত্য ধর্ষণ বা বিয়ের মধ্যে কোনো প্রকার যৌন জবরদস্তি সমর্থন করে না।

ইসলাম একটি মানবিক ধর্ম যা সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে ভালোবাসা, করুণা, পারস্পরিক সম্মান এবং সম্মতির উপর। যে স্বামী তার স্ত্রীর অসম্মতি বা কষ্টকে উপেক্ষা করে কেবল নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণে লিপ্ত হন, তিনি কেবল স্ত্রীর প্রতিই জুলুম করেন না, বরং তিনি আল্লাহর দেওয়া পবিত্র আমানত—বিবাহ— এবং ইসলামের মূল শিক্ষার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেন।

ইসলাম নারীকে সম্মান দিয়েছে, তার অনুভূতিকে মর্যাদা দিয়েছে এবং জোরপূর্বক সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সত্যটি অনুধাবন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য জরুরি।