গৌতম বুদ্ধের দর্শন ও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চারটি মৌলিক সত্য, যা ‘চার আর্যসত্য’ নামে পরিচিত। এই সত্যগুলো তিনি তাঁর বোধিলাভের পর গভীর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলেন। এগুলো কোনো ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ নয়, বরং মানব জীবনের বাস্তব পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণের একটি যুক্তিনিষ্ঠ ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষণ।
এই চার সত্য জীবনের রোগ নির্ণয়, রোগের কারণ শনাক্তকরণ, আরোগ্যের সম্ভাবনা এবং আরোগ্যের উপায় হিসেবে দেখা যেতে পারে। আসুন, শান্ত ও স্থিরভাবে এই চারটি সত্যকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি।
প্রথম সত্যটি হলো জীবনের অন্তর্নিহিত দুঃখ বা অসন্তোষের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। বুদ্ধ বলেন, জীবনে দুঃখ আছে। এই ‘দুঃখ’ শব্দটি কেবল শারীরিক বা মানসিক কষ্টকে বোঝায় না, এর অর্থ আরও ব্যাপক। জন্ম দুঃখ, বার্ধক্য দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ। অপ্রিয় বিষয়ের সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিষয়ের বিয়োগ দুঃখ। যা চাওয়া যায়, তা না পাওয়াও দুঃখ।
সংক্ষেপে, পরিবর্তনশীল ও শর্তাধীন জগতের সবকিছুই অনিত্য এবং এই অনিত্যতার অভিজ্ঞতাই মূলত দুঃখ বা অসন্তোষের জন্ম দেয়। এমনকি যা কিছুকে আমরা ‘সুখ’ বলে মনে করি, তাও অস্থায়ী এবং তার অবসানে আবার দুঃখের অনুভূতি হয়। এটি জীবনের একটি নির্মোহ ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ, কোনো হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নয়। জীবনের এই মৌলিক সত্যকে শান্তভাবে স্বীকার করাই হলো জ্ঞানের প্রথম পদক্ষেপ।
দ্বিতীয় সত্যটি এই দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করে। বুদ্ধ শেখান যে, দুঃখের মূল কারণ হলো ‘তৃষ্ণা’ বা আসক্তি। এই তৃষ্ণা বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে: ইন্দ্রিয়সুখের তৃষ্ণা , অস্তিত্বের প্রতি তৃষ্ণা (ভব তৃষ্ণা), এবং অনস্তিত্ব বা ধ্বংসের প্রতি তৃষ্ণা (বিভব তৃষ্ণা)। এই অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা এবং আঁকড়ে ধরার প্রবণতাই আমাদের মনকে অস্থির করে তোলে এবং বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ রাখে। যা কিছু অনিত্য, তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়ার বাসনাই দুঃখকে অনিবার্য করে তোলে। এই তৃষ্ণা এক অন্তহীন চাওয়া, যা কখনও পূর্ণ হয় না এবং আমাদের অশান্তি ও অতৃপ্তির গভীরে নিমজ্জিত রাখে।
তৃতীয় আর্যসত্য: দুঃখ নিরোধ
তৃতীয় সত্যটি আশার আলো দেখায়। এটি ঘোষণা করে যে, দুঃখের অবসান বা নিরোধ সম্ভব। যদি দুঃখের কারণ থাকে (তৃষ্ণা), তবে সেই কারণকে দূর করতে পারলেই দুঃখ থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই দুঃখ মুক্তির অবস্থাই হলো ‘নির্বাণ’। নির্বাণ মানে ‘নিভে যাওয়া’ –
কিসের নিভে যাওয়া? তৃষ্ণা, দ্বেষ এবং অজ্ঞতার আগুনের নিভে যাওয়া। এটি এক পরম শান্ত অবস্থা, যেখানে সকল প্রকার বন্ধন, আসক্তি ও দুঃখের অবসান ঘটে। এটি শূন্যতা নয়, বরং পূর্ণ শান্তি, মুক্তি ও অনাবিল স্থিরতার অভিজ্ঞতা।
এই সত্য আমাদের জানায় যে, মানবীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুঃখের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।
চতুর্থ আর্যসত্য: দুঃখ নিবারণের পথ
চতুর্থ এবং শেষ সত্যটি হলো সেই পথ বা উপায়, যার মাধ্যমে দুঃখ নিরোধ বা নির্বাণ লাভ করা যায়।
এই পথটি হলো ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বা আটটি অঙ্গবিশিষ্ট মহৎ পথ।
এটি কোনো চরমপন্থা নয়, বরং একটি ‘মধ্যমপন্থা’ – যা একদিকে যেমন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনকে পরিহার করে, তেমনি অন্যদিকে ইন্দ্রিয়সুখে গা ভাসিয়ে দেওয়াকেও নিরুৎসাহিত করে। এই আটটি অঙ্গ হলো:
সম্যক দৃষ্টি (সঠিক উপলব্ধি): চার আর্যসত্যকে সঠিকভাবে জানা ও বোঝা।
সম্যক সংকল্প (সঠিক চিন্তা): আসক্তিহীন, অহিংস এবং মৈত্রীপূর্ণ চিন্তা।
সম্যক বাক্য (সঠিক বাক্য): মিথ্যা, কটু, বিভেদ সৃষ্টিকারী ও অসার বাক্য বর্জন করা।
সম্যক কর্ম (সঠিক কর্ম): অহিংসা, চুরি না করা এবং সংযমী জীবনযাপন।
সম্যক আজীব (সঠিক জীবনযাপন): সৎ ও অন্যের ক্ষতির কারণ নয় এমন জীবিকা নির্বাহ করা।
সম্যক প্রযত্ন (সঠিক প্রচেষ্টা): অকুশল বা মন্দ চিন্তা দূর করা ও কুশল বা ভালো চিন্তা উৎপন্ন ও বৃদ্ধি করার চেষ্টা।
সম্যক স্মৃতি (সঠিক মনোযোগ): নিজের শরীর, অনুভূতি, মন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকা (মাইন্ডফুলনেস)।
সম্যক সমাধি (সঠিক একাগ্রতা): মনকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থির ও একাগ্র করার অনুশীলন।
বুদ্ধ বলেন জীবনে এই পথে চলার মাধ্যমেই তৃষ্ণার অবসান ঘটে এবং নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়।
বুদ্ধের চার আর্যসত্য কোনো জটিল দর্শন বা অন্ধ বিশ্বাস নয়। এটি জীবনের দুঃখময় বাস্তবতাকে স্বীকার করে, তার কারণ বিশ্লেষণ করে, মুক্তির সম্ভাবনা দেখায় এবং সেই মুক্তির জন্য একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত ও অনুশীলনযোগ্য পথনির্দেশ করে। শান্ত ও স্থির মনে এই সত্যগুলোকে অনুধাবন ও অনুশীলন করতে পারলে, জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হতে পারে এবং আমরা ধীরে ধীরে দুঃখ ও অস্থিরতা থেকে মুক্তি লাভ করে পরম শান্তির দিকে অগ্রসর হতে পারি।