একদিন শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ডিং শেষে বাড়ি ফিরছিলেন নজরুল ইসলাম। পথিমধ্যে তাঁর পথ রোধ করেন সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন। আব্বাসউদ্দীনের আবদার— তিনি চাইছেন নজরুল ইসলাম যেনো একটি ইসলামি গান লেখেন।

নজরুল একটু অবাক হলেও, বন্ধুর আন্তরিকতার সামনে বাধা দিলেন না। মৃদু হেসে বললেন, “বলে ফেলো তোমার আবদার।”

আব্বাসউদ্দীন তখন নিজের কথা খুলে বললেন। তিনি দেখছেন, পূজোর সময় পেয়ারু কাওয়ালের গান বাজার মাতিয়ে দিচ্ছে, হাজার হাজার মুসলমান সেই রেকর্ড কিনছে। অথচ ঈদের জন্য, মুসলমানদের নিজস্ব উৎসবের জন্য কোনো গান নেই। নজরুল যদি একটি ইসলামি গান লেখেন, তবে তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যাবে।

বাজার তখন শ্যামাসঙ্গীতের দখলে। এমনকি মুসলিম শিল্পীরাও হিন্দু নাম ধারণ করে শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন।
নজরুল নিজেও ব্যস্ত শ্যামাসঙ্গীত আর প্রেমের গান নিয়ে।

তারপরও আব্বাসউদ্দীনের আবেগ ছুঁয়ে গেল নজরুলকে। তবে সহজে সম্মতি দিলেন না। বললেন,
“ভগবতী বাবুকে রাজি করাতে পারলে, তখন দেখা যাবে।”

ভগবতী বাবুর কাছে যুদ্ধ
গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ ভগবতী ব্যানার্জি তখন ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ নিতে নারাজ।
তিনি সরাসরি বললেন,
“মুসলমানদের পয়সা নেই। ঈদের গান কেউ কিনবে না। ব্যবসায় লোকসান হবে।”

কিন্তু আব্বাসউদ্দীন নাছোড়বান্দা। ছয় মাস ধরে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯৩১ সালের এপ্রিলের এক সকালে, ভগবতী বাবু অনিচ্ছাভরে একটা সুযোগ দেন—
“গান নিয়ে এসো। শুনে দেখি। যদি ভালো লাগে, বের করবো।”

গান বাঁধা: পান, চা আর হৃদয়ের আবেগ
আব্বাসউদ্দীন দৌড়ে যান নজরুলের কাছে।
নজরুল পান-চা চেয়ে একটু আড়মোড়া ভাঙলেন, তারপর একটা কাগজ নিয়ে রিডিং রুমে ঢুকে পড়লেন।

মাত্র আধা ঘণ্টার মাথায় ফিরে এসে আব্বাসউদ্দীনের হাতে কাগজটি ধরিয়ে দিলেন। সেই কাগজে লেখা ছিল:

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।”

আব্বাসউদ্দীনের চোখ জলে ভরে উঠলো। ছয় মাসের সাধনার ফল হাতে পেলেন তিনি— হৃদয়ের গভীর থেকে জন্ম নেওয়া একটি গান।

গান প্রকাশ এবং ইতিহাস সৃষ্টি
রেকর্ডিং শেষ হয় দ্রুত। ঈদের আগেই রেকর্ড বাজারে আসে।
ঈদের ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে আব্বাসউদ্দীন দেখেন— রাস্তায়, ট্রামে, মাঠে, সর্বত্র মানুষ গাইছে:
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে…”

রেকর্ডের চাহিদা এত বেশি হয় যে, বিভূতিবাবুর দোকানে রেকর্ড আর পোস্টার ফুরিয়ে যায়।

আব্বাসউদ্দীন ছুটলেন নজরুলের কাছে।
নজরুল তখন দাবা খেলায় মগ্ন। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের খবর শুনে খেলাই ভুলে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন:
“আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে!”

নতুন যুগের সূচনা
এই গানের সাফল্যে গ্রামোফোন কোম্পানি আর পিছিয়ে থাকেনি।
এরপর নজরুল একের পর এক ইসলামি গান লিখলেন, আব্বাসউদ্দীন গাইলেন।
বাংলা গানে নতুন এক ধারা জন্ম নিল— ইসলামি সঙ্গীতের ধারা।

একসময় মুসলিম শিল্পীরা হিন্দু নাম নিয়ে গান গাইতেন। এখন হিন্দু শিল্পীরাও মুসলিম নাম ধারণ করে ইসলামি গান গাইতে শুরু করলেন।
ধীরেন দাস হয়ে গেলেন গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে গেলেন দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে গেলেন সোনা মিয়া…

বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতে মুসলিম পরিচয়ের অন্দরে নজরুল সৃষ্টি করলেন প্রবল ঝড়।

নজরুলের নিখাদ ভালোবাসা
নজরুলের এই ইসলামী গানগুলো কেবল গান ছিল না।
এগুলো ছিল তাঁর শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর শৈশবের স্মৃতি, তাঁর ধর্মীয় আবেগের শিল্পরূপ।

একদিন আব্বাসউদ্দীন গজল চাইতে গেলে, নজরুল নামাজরত আব্বাসকে দেখে, তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের কলম চালিয়ে লিখে ফেললেন:

“হে নামাজী!
আমার ঘরে-
নামাজ পড়ো আজ,
দিলাম তোমার চরণতলে
হৃদয় জায়নামাজ।”

এই হৃদয়ের জায়নামাজেই নজরুল বাঙালি মুসলমানকে দাঁড় করিয়েছিলেন— এক গৌরবময় সম্মানের জায়গায়।

উপসংহার: আজও অম্লান সেই গান
আজ ঈদুল ফিতর।
বাংলাদেশের রাস্তায়-ঘাটে, গ্রামে-শহরে, মসজিদে-মাঠে, আজও বেজে ওঠে সেই একই গান:

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…”

জাতীয় সংগীতের মতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই গান।
এই গান কেবল ঈদের গান নয়— এটি বাঙালি মুসলমানের আত্মার গান, ইতিহাসের গান, ভালোবাসার গান।

নজরুলের ১২৫ বছর পরেও, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি।
বরং সময় যত এগোয়, তাঁর হৃদয়ের ডাকে আমরা বারবার ফিরে যাই।

আজ ঈদের শুভক্ষণে, আসুন আমরা আবার মনে করি—
নজরুল কেবল এক কবির নাম নয়, তিনি বাঙালির নিঃশ্বাসে-রক্তে মিশে থাকা এক অবিনশ্বর অনুরণন।