নবী নূহের প্লাবনের গল্প বাইবেল ও কোরআনে গুরুত্বপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পৃথিবীতে যখন পাপাচার চরমে পৌঁছায়, ঈশ্বর তখন ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন। নূহ নবীকে নির্দেশ দেন একটি বিশাল নৌকা নির্মাণ করতে এবং প্রতিটি প্রজাতির প্রাণীদের এক জোড়া করে সেই নৌকায় নিতে।
প্লাবনে সমগ্র পৃথিবী ডুবে যায়।
শেষ পর্যন্ত পানি নেমে গেলে, নূহের নৌকা স্থির হয় এক পাহাড়ে। এখান থেকে শুরু হয় মানব সভ্যতার নতুন অধ্যায়।
মনুর মহাপ্লাবন: মৎস পুরাণের গল্প
হিন্দু পুরাণে, রাজা বৈবস্বত মনুকে ভগবান বিষ্ণু সতর্ক করেন—
একটি বিশাল প্লাবন আসছে। মনু বিশাল নৌকা তৈরি করেন। সমস্ত প্রাণী, ঔষধি গাছ, এবং সাত ঋষি সেই নৌকায় আশ্রয় পান।
ভগবান বিষ্ণু মৎস্য অবতারে এসে মনুর নৌকাকে রক্ষা করেন।
প্লাবন শেষে, মনু ও তার সঙ্গীরা নতুন পৃথিবী গড়ে তোলেন।
জামশেদের প্লাবন: জরাথ্রুষ্টীয় বিশ্বাস
জরাথ্রুষ্টীয় ধর্মগ্রন্থ ‘জিন্দাবেস্তা’ বলছে, আহুরা মাজদা রাজা জামশেদকে সতর্ক করেন এক মহাপ্লাবনের জন্য।
জামশেদ নৌকা নির্মাণ করেন, যেখানে শ্রেষ্ঠতম মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদরূপী প্রাণ বাঁচানো হয়।
প্লাবনের শেষে শুরু হয় নববর্ষ ‘নওরোজ’ উৎসবের সূচনা।
গিলগামেশের মহাপ্লাবন
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার গিলগামেশ মহাকাব্যে উটনা-পিশটিম স্বপ্নযোগে জানতে পারেন মহাপ্লাবনের কথা।
তিনি বিশাল নৌকা তৈরি করে নিজ পরিবার ও প্রাণীজগতকে রক্ষা করেন।
প্লাবনের পরে, তার নৌকা স্থির হয় নিশির পর্বতে।
মহাপ্লাবনের আরও ছায়া
গ্রীক পুরাণে জিউসের আদেশে প্লাবন; ডিউকালিয়ন ও পাইরা বেঁচে যান।
নর্স পুরাণে দৈত্য ইমিরের রক্তে প্লাবন হয়।
চীনা পুরাণে দেবী নুওয়া আকাশ মেরামত করে বন্যা থামান।
আফ্রিকান, মায়ান, ইনকা, ফিজি, ক্যারিবিয়ান, মঙ্গোলীয় সভ্যতাগুলোর পুরাণেও রয়েছে একে অপরের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ প্লাবনের গল্প।
তাহলে আসলেই কী ঘটেছিল?
পৃথিবীর নানা পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ আর লোককথা আমাদের জানায়—
খ্রিস্টের জন্মের ২,৫০০ থেকে ৯,০০০ বছর আগে পৃথিবীর বড় অংশে এক ভয়াবহ প্লাবন ঘটেছিল।
কোনো এক বাস্তব ব্যক্তি একটি নৌকা নির্মাণ করে অনেক মানুষ ও প্রাণীকে সেই দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
তিনি কেবল মানবজাতিকে নয়, সমগ্র প্রাণীকূলকেও রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
এই মহাপ্লাবনের গল্প আমাদের বলে— সংকট এলেও, যদি আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি, এক নৌকায় উঠি, সহানুভূতি রাখি প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি—তবে টিকে থাকা সম্ভব।
ধর্ম, গল্প, এবং ঐক্যের বোধ
আজকের সমাজে আমরা প্রায়ই দেখি—“শুধু আমার ধর্মই সত্য।” কিন্তু যখন দেখি নূহ, মনু, জামশেদ, গিলগামেশ—সবাই একই মূল গল্পের বাহক, তখন বুঝি—
সত্য একাকার হয়ে থাকে বিভিন্ন বিশ্বাসে।
নিজের সত্যকে প্রমাণ করতে হলে অন্যের সত্যের অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়।
বিশ্বজগত একটাই গান গায়—ভালোবাসার গান, ঐক্যের গান।
আমাদেরও চাই এক নৌকা
আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, মহামারী, ধ্বংসাত্মক সংকট আসছে বারবার।
এখনও সময় আছে আমাদের জন্য নিজেদের ‘নূহের নৌকা’ বানানোর।
সুফি সাধক সদর উদ্দিন চিশতী বলেছেন—
সংকটের সময় নিজের দেহ ও মনকে সেই নৌকা বানাও। অহংকার ও ইগোকে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দাও। যাদের ভালোবাসো, যাদের পাশে রাখলে জীবন নিরাপদ হয়, তাদের নাও নিজের নৌকায়।
ধৈর্য রাখো, বিশ্বাস রাখো—একদিন তুমি সেই দুঃসময় পেরিয়ে নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছে যাবে।
শেষ কথা
মানব ইতিহাসের মহাপ্লাবনের গল্প কেবল অতীতের নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্যও এক চেতনাবোধ।
আজও আমাদের প্রয়োজন সেই সমবেত প্রচেষ্টা, সেই ভালোবাসা, সেই বৃহৎ মন।
নতুন ‘ঐক্যতানের’ সুরে, নতুন আশার নৌকায়, আবারও মিলিত হই আগামীর জগৎ গড়তে।