১৭৮৭ সালের জানুয়ারিতে, আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের প্রধান খসড়াকারী ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি সংবাদপত্র ছাড়া সরকারকে পছন্দ করবো না, বরং সরকার ছাড়া সংবাদপত্রকে পছন্দ করবো।”
একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন রাষ্ট্রের চেয়েও সংবাদমাধ্যমকে এগিয়ে রাখেন, তখন এটা স্পষ্ট হয় যে, সত্য বলার শক্তিটাই গণতন্ত্রের প্রকৃত চালিকাশক্তি।
আজ, ৩ মে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে এই দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। এর পেছনেও আছে সাংবাদিকদের জোরালো ভূমিকা রাখার ইতিহাস।
১৯৯১ সালে নামিবিয়ার উইন্ডহুক শহরে ইউনেসকোর এক সেমিনারে আফ্রিকার সাংবাদিকরা উপনিবেশ, সেন্সরশিপ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন—
“একটি স্বাধীন, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমই হলো গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি। যখন সত্যের প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন রাষ্ট্রের ভিত নড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় এবং মানুষের অধিকার—সবকিছুই টিকে থাকে একটিমাত্র স্তম্ভের ওপর: তথ্যের স্বাধীন প্রবাহ।”
অথচ আমরা দাঁড়িয়ে আছি যেন এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে সাংবাদিকতা মানেই আতঙ্ক, গণমাধ্যম মানেই লক্ষ্যবস্তু।
নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট জানায়, ২০২৩ সালে কাজ করতে গিয়ে নিহত হন ১০২ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে ৭২ জনই ফিলিস্তিনি। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান আরো ভয়ানক। প্রাণ হারান ১২৪ জন সাংবাদিক। যেন যুদ্ধটা হচ্ছে ক্যামেরা আর কলমের বিরুদ্ধে।
জেনেভা ভিত্তিক মনিটরিং সংস্থা প্রেস এম্বলেম ক্যাম্পেইনের তথ্য, গত ২০ বছরে খুন হয়েছেন ২,০০০-এর বেশি সাংবাদিক। আর রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের হিসাব অনুযায়ী, শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে নিহত হয়েছেন ৫৪ জন সাংবাদিক। আর এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, নিহত হয়েছিলেন ৫ জন সাংবাদিক।
আর্টিকেল-১৯ বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ১১৫টি মামলা। আসামির তালিকায় ২২৯ জন, গ্রেপ্তার ৫৬ জন।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ভয়াবহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া প্রায় ৭,০০০ মামলার ২৭ শতাংশ মামলা হয়েছে কেবল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে!
২০১৭ সালে he Economic Times-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, “মানুষ কথা বলতে ভয় পেলে বুঝতে হবে গণতন্ত্র নেই।”
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর যেই আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র নির্মাণের কথা হচ্ছিলো, সাংবাদিকরাও সেই আকাঙ্ক্ষায় হিস্যা রাখেন, গণ মাধ্যম কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে, অনেক ভাল ভাল সংস্কারের আলাপ এসেছে কিন্তু পাশাপাশি মত প্রকাশে মবের আক্রমণও কম দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের কর্তাদের সাথে মতের অমিলের কারণে চাকরি হারাতে হয়েছে অনেককেই।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আমরা বাংলাদেশেও চাই মুক্তবাকের নিশ্চয়তা। আজ প্রশ্ন তুলতে হবে- গণতন্ত্র মানে কেবলই কি নির্বাচন? নাকি গণমাধ্যমের সত্য বলার সাহসও গণতন্ত্র?