ইউবি-কুইটি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর জিম গ্যারিসন, যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মদর্শনে পিএইচডি করেন এবং হাভার্ডে ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন, ২০১৬ সালের অক্টোবরে হাফিংটন পোস্টে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল: “Muhammad Was a Feminist”।

আজকের আলোচনায় আমরা এই লেখার মূল ভাবনাগুলোর ভেতরে ডুব দেবো।

প্রথমেই বলা ভালো, ডক্টর জিম গ্যারিসন মুসলিম নন। আমিও একজন আগ্রহী ছাত্র, এখনো শেখার পথে। তাই কোনো ভুলত্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাদের উদ্দেশ্য কারো বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া নয়, বরং এমন কিছু সামনে আনা— যা হয়তো আমাদের চিন্তাজগতকে একেবারে নতুনভাবে আলোড়িত করতে পারে।

নবী মুহাম্মদ ও নারীর স্বাধীনতা
ডক্টর জিম লিখছেন, আজকের দিনে ইসলামী সমাজের উচিত নারীদের সেই স্বাধীনতা দেওয়া, যেমনটা নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সময়ের নারীদের দিয়েছিলেন এবং যেটা কুরআনেও প্রতিষ্ঠিত আছে।
তিনি বলেন, আজকের মৌলবাদী ইসলামী সমাজে নারীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চলে, তা নবী মুহাম্মদের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

নারীদের প্রতি এই নিপীড়ন মূলত পুরুষশাসিত সাংস্কৃতিক ধারা এবং ঐতিহাসিক বিকৃতির ফসল, কুরআন বা নবী মুহাম্মদের প্রকৃত শিক্ষা নয়।

ডক্টর জিম আরো বলেন, ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নবী মুহাম্মদ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি র‍্যাডিকাল ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমনকি তাকে “ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী” বললেও অত্যুক্তি হয় না।

ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদের ব্যতিক্রমী ভূমিকা
ডক্টর জিম ধর্মীয় ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখান:

কনফুসিয়াস নারীদের কথা তেমন গুরুত্ব দেননি।

বুদ্ধ নারীদের আলোকপ্রাপ্তির অধিকার দিলেও, সেটা দিতে তাকে তিনবার চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল।

যীশু নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন, তবে সমাজ বদলে দেয়ার মতো সরাসরি কোনো সামাজিক সংস্কার করেননি।

মুসা (আ.)-এর সমাজেও নারীদের অবস্থান ছিল সীমিত।

এর বিপরীতে, মুহাম্মদ (সা.) সরাসরি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন।

তিনি নারী ও পুরুষের আধ্যাত্মিক সমতাকে ইসলামের মৌলিক নীতির অংশ হিসেবে শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

মুহাম্মদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং নারী সংবেদনশীলতা
ডক্টর জিম ব্যাখ্যা করেন, নবী মুহাম্মদ নিজে দারিদ্র্য ও এতিমত্বের মধ্যে বড় হয়েছেন।
তিনি নিরক্ষর ছিলেন। ফলে দরিদ্রতা, বঞ্চনা আর সামাজিক নিগ্রহের কষ্ট তিনি গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন।
অন্যদিকে, কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, যীশু বা মুসা— প্রত্যেকেই তুলনামূলকভাবে উচ্চবর্গীয় বা নিরাপদ সামাজিক অবস্থান থেকে এসেছিলেন।

এই জীবন-অভিজ্ঞতাই মুহাম্মদ (সা.)-কে নারীর দুঃখ-কষ্টের প্রতি আরো সংবেদনশীল করে তুলেছিল।

নারীদের জন্য মুহাম্মদের বিপ্লবী সংস্কার
সপ্তম শতকের আরব সমাজে নারীরা ছিল সম্পত্তির মতো, তাদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। মেয়েশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়ার ঘটনাও ঘটতো।

নবী মুহাম্মদ (সা.) এই প্রথাগুলো চ্যালেঞ্জ করেন:

কন্যাশিশু জন্মকে “আশীর্বাদ” বলে ঘোষণা করেন।

নারীদের সম্পত্তির মালিকানা এবং উত্তরাধিকারের অধিকার দেন।

বিবাহের জন্য নারীর সম্মতি বাধ্যতামূলক করেন।

দেনমোহর নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে নির্ধারণ করেন।

নারীদের তালাকের অধিকার দেন।

বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারীর দেনমোহর ফেরত পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন।

এসব সংস্কার সপ্তম শতকের দুনিয়ায় ছিল অভূতপূর্ব।

মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবন ও নারীসম্মান
নবী মুহাম্মদ (সা.)-র ব্যক্তিগত জীবনও তার নারীবাদী মনোভাবের প্রতিফলন।

তিনি খাদিজা (রা.)-এর সাথে দীর্ঘ ১৫ বছর মনোগ্যামাস বিবাহিত জীবন কাটান, যা সেই সময়ের আরবে অত্যন্ত বিরল ছিল। খাদিজা (রা.) ছিলেন তার জীবনের প্রথম সমর্থন, প্রথম মুসলিম, এবং নবুয়তের প্রথম ঘোষণা পাওয়া মুহূর্তেও তাকে নির্ভরতা ও শক্তি যুগিয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে নবী (সা.) বেশিরভাগ বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত ও নিঃস্ব মহিলাদের আশ্রয় দেন। তার বিবাহ ছিল সমাজের দুর্বল, নিপীড়িত নারীদের মর্যাদা ও সুরক্ষার জন্য।

তার বিদায়ী ভাষণে তিনি বলেছিলেন:
“নারীদের উপর তোমাদের কিছু অধিকার আছে, তোমাদের উপরও তাদের অধিকার আছে।”

তিনি আরো বলেছিলেন:
“সর্বোত্তম পুরুষ তারাই যারা স্ত্রীদের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করে।”

নবীর মৃত্যুর পর নারীদের ভূমিকা
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আয়েশা (রা.) হাদিস সংকলনে নেতৃত্ব দেন এবং অন্যান্য স্ত্রীগণ কুরআনের সূরাগুলো সংরক্ষণে ভূমিকা রাখেন।
নারীরা ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে ছিল শিক্ষার, জ্ঞানের এবং নেতৃত্বের কেন্দ্রে।

করুণা এবং নারীবাচক ঈশ্বরচিন্তা
ডক্টর জিম গ্যারিসন আরও স্মরণ করিয়ে দেন, কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ১১৩টিই শুরু হয়েছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” দিয়ে।
এখানে “রাহমান” ও “রাহিম” শব্দ দুটির মূল ধাতু ‘রেহেম’, যার অর্থ ‘গর্ভাশয়’— একেবারে নারীর মাতৃত্বের প্রতীক।

অর্থাৎ কুরআনের শুরুতেই ঈশ্বরের পরিচয় দেওয়া হয়েছে মমতা, দয়া এবং মাতৃসুলভ করুণার মাধ্যমে।
এটিই ইসলামিক রেনেসাঁর চাবিকাঠি— নারী ও করুণার সম্মিলিত এক দৃষ্টিভঙ্গি।

উপসংহার: ইসলামের ভবিষ্যৎ এবং নারীর মুক্তি
ডক্টর জিম গ্যারিসন লেখেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) নারীদের জন্য যে বিপ্লবী অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা তখনকার দুনিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সমসাময়িক অনেক মুসলিম সমাজ নারীদের ওপর মধ্যযুগীয় নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে।

ইসলামী সভ্যতার পুনরুত্থান যদি সত্যিকার অর্থে সম্ভব হয়, তবে এর কেন্দ্রে থাকতে হবে নারীদের পূর্ণ মুক্তি।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উদাহরণ এবং কুরআনের করুণা ও দয়ার নারীবাচক ব্যাখ্যা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে।

সত্যিকারের ইসলামী রেনেসাঁর সূত্রপাত হবে সেখান থেকেই— যেখানে নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক হয়ে, সম্মানের বন্ধনে, সভ্যতার নতুন অধ্যায় রচনা করবে।