ছবিটা দেখুন—একদিকে এক দেবী, তার পাশে দাঁড়ি ও টুপি পরা এক পীরের মূর্তি। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, এখানে যেন দুই ধর্মের দুটি আলাদা বিশ্বাস একসঙ্গে মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে।
আসলে এটাই সত্য। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও ভারতের দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আজও গাজীর পীর ও বনবিবি একত্রে পূজিত হন। এই আখ্যান শুধু লোকবিশ্বাসের গল্প নয়—এ এক আশ্চর্য শিক্ষা, যেখানে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় মিলনের পাশাপাশি পরিবেশ ও জীবনের গভীর বোঝাপড়ার ছাপও পাওয়া যায়।
গাজীর পীর: লোককথার অলৌকিক রক্ষাকর্তা
গাজীর পীরের পরিচয় নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বেলে-আদমপুর গ্রামের সন্তান, কেউ বলেন সিলেট জেলার শিবগাঁও গ্রামের। পাণ্ডুয়ার জাফর খাঁ গাজীর পুত্র বলেও তাকে অনেকে উল্লেখ করেন। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে, তিনি ছিলেন চতুর্দশ শতকের সুফি খান, যিনি পরে বড়খাঁ গাজী নামে খ্যাতি অর্জন করেন। আবার কেউ তাকে ইসমাইল গাজীর সঙ্গেও যুক্ত করেন।
মতবিরোধ যাই থাক, লোককাহিনি বলে—গাজী পিতৃঐশ্বর্য ত্যাগ করে ফকিরি জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। সুন্দরবনের দুর্গম বনে তিনি ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন এবং অলৌকিক ক্ষমতার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। বাঘ, কুমির, সাপের মতো ভয়ংকর প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শক্তি ছিল তার। আজও মধু সংগ্রহকারী, জেলে, কাঠুরেরা সুন্দরবনে প্রবেশের আগে গাজীর পীরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
বনবিবি: বনের মাতৃত্বের প্রতীক
বনবিবির জন্মকাহিনীও লোকগাথায় ভরপুর। বলা হয়, বনবিবি ও তার ভাই শাহ জঙ্গলী মক্কার ইব্রাহিম ফকিরের সন্তান। স্বর্গ থেকে তাদের পাঠানো হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে: সুন্দরবনের জীব-জগতের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। বনবিবি সুন্দরবনের জীবজন্তু ও মানুষ—সবকিছুর রক্ষাকর্ত্রী হয়ে ওঠেন।
তার অলৌকিক ক্ষমতা ও মাতৃসুলভ স্নেহ আজও সুন্দরবনের মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত। বনবিবি কেবল বনের দেবী নন; তিনি সমতা, সহানুভূতি আর সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল প্রতীক।
দক্ষিণরায়: বাঘদেবতার প্রভাব
সুন্দরবনের গভীর বনে দক্ষিণরায় নামে পরিচিত ব্যাঘ্রদেবতার প্রভাব ছিল সর্বত্র। তার আইন ছিল কঠিন—বনে ঢোকা মানুষকে প্রাণ দিতে হবে। তবে এক শিশুর দোয়া ও বনবিবির কৃপায় এই নিয়ম ভাঙে।
একবার এক মৌয়াল তার শিশুপুত্র দুখেকে সঙ্গে করে বনে নিয়ে যায়। সেখানে ছেলেটি হারিয়ে গেলে দক্ষিণরায় তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু দুখের আর্তিতে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী এসে দক্ষিণরায়কে পরাজিত করেন। পরাজিত দক্ষিণরায় তখন আশ্রয় নেন গাজীর পীরের কাছে। গাজী পীরের মধ্যস্থতায় বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের মধ্যে এক সন্ধি হয়।
মিলনের গল্প: বন, মানুষ ও বিশ্বাসের সমঝোতা
এই ঘটনার পর বনবিবি, গাজীর পীর ও দক্ষিণরায় একটি সমঝোতায় পৌঁছান। সিদ্ধান্ত হয়:
দক্ষিণরায় বনের গভীরে থাকবেন,
মানুষ বনবিবির আশ্রয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করবেন,
গাজীর পীর মানুষ ও জীবের মধ্যে সাম্য ও রক্ষা নিশ্চিত করবেন।
এভাবেই সুন্দরবনের বনে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন তৈরি হয়।
বহুমাত্রিক উপস্থাপনা
বনবিবি হিন্দু সমাজে বনদুর্গা, বনচণ্ডী বা বনদেবী নামে পরিচিত, তার গায়ের রং হলুদ, গলায় বনফুলের মালা। মুসলিম সমাজে তিনি বনবিবি পিরানি—টুপি ও টিকলি পরিহিত, ঘাগরা-পাজামা পরা। দুটি সংস্করণেই তার কোলে থাকে সেই ছোট দুখে, যার জন্য প্রথম যুদ্ধ বাধে।
গাজীর পীরের প্রতিমাও নানা রূপে দেখা যায়—টুপিপরা এক অলৌকিক পুরুষ, কখনো হাতে তরবারি, কখনো বাঘের সঙ্গী।
আজকের শিক্ষা
আজকের এই আধুনিক সময়েও গাজীর পীর ও বনবিবির গল্প শুধু একটি কিংবদন্তি নয়। এটা আমাদের শেখায়—
ধর্মীয় বিভাজন ছাড়িয়ে কিভাবে সহাবস্থান সম্ভব,
প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী ও উপাদানের সাথে বোঝাপড়া করে টিকে থাকা কেমন হতে পারে।
আমরা যখন প্রকৃতিকে শত্রু ভাবি, বন উজাড় করি, পশুদের হত্যা করি, তখন এই গল্প মনে করিয়ে দেয়: টিকে থাকতে হলে প্রকৃতির সাথে আমাদের বোঝাপড়া করতে হবে, সহানুভূতিতে গড়ে তুলতে হবে একসঙ্গে বেঁচে থাকার নীতি।
সুন্দরবনের এই প্রাচীন আখ্যান আজও সমান প্রাসঙ্গিক—ভবিষ্যতের টিকে থাকার জন্য যেমন মানুষের কাছে, তেমনি প্রকৃতির কাছেও।