সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই। গান যাঁর রক্তে মিশে ছিল, সেই সুরের জাদুকর পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। তাঁর এই প্রয়াণে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতি জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আব্বাসীর জীবন ছিল গান, লেখালেখি আর গবেষণায় পরিপূর্ণ এক বর্ণময় ক্যানভাস।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সংগীতপ্রীতির শিকড় প্রোথিত ছিল তাঁর পারিবারিক আবহে। তাঁর বাবা, কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ছিলেন সেই পথিকৃৎ যিনি গ্রামবাংলার মাটির সুরকে শহরের মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কুচবিহারের ধানখেতের আল থেকে সুর তুলে এনে তিনি তাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দীন কেবল লোকসংগীত নয়, কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গানকেও জনপ্রিয় করে তোলেন। নজরুলের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা ছিল আজীবন; তিনি বলতেন, ‘আমার শরীরের প্রতি লোমকূপ নজরুলের কাছে ঋণী।’ এই সংগীতময় পরিবেশেই মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বেড়ে ওঠা। ছোট্টবেলা থেকেই গান শোনা আর গান গাওয়ার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তা আজীবন তাঁর সঙ্গী ছিল।
কুচবিহার থেকে কলকাতা, তারপর ঢাকা – আব্বাসীদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে সংগীতের এই আবহও স্থানান্তরিত হয়েছে। কলকাতার ৬ নম্বর বেনেপুকুর লেনের বাড়িটি ছিল কবি গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, আসাদউদ্দৌলা শিরাজী, তালিম হোসেন, বেদার উদ্দীন আহমদ, সোহরাব হোসেনের মতো দিকপালদের আনাগোনায় মুখর এক সংগীততীর্থ। ঢাকায় আসার পরেও পল্টনের বাসায় সেই ধারা অব্যাহত ছিল। কবি সুফিয়া কামাল, ইব্রাহীম খাঁ, আবদুল লতিফ, শামসুর রাহমানের মতো ব্যক্তিত্বদের পদচারণায় মুখরিত থাকত সেই গৃহ। আব্বাসী স্মৃতিচারণ করতেন, নববর্ষের প্রথম দিনে তাঁদের বাসায় গানের জলসা বসত, যেখানে তাঁর বাবা কবিতা আবৃত্তি করতেন আর ভাইবোনেরা গাইতেন গান।
যদিও আব্বাসউদ্দীন ছিলেন লোকসংগীতের সম্রাট, তিনি চাইতেন তাঁর সন্তানেরা হিন্দুস্তানি সংগীতে পারদর্শী হোক। এই লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে কলকাতায় তিনি ওস্তাদ জমির উদ্দীন খাঁ সাহেবের ভাইয়ের ছেলে কাদের জামিরিকে নিযুক্ত করেন মুস্তাফা জামান ও তাঁর বোন ফেরদৌসী রহমানকে তালিম দেওয়ার জন্য। তখন মুস্তাফা জামানের বয়স সাত আর ফেরদৌসীর সাড়ে চার। ভূপালি রাগ দিয়ে তাঁদের সংগীতজীবনের সেই আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি। পরে ওস্তাদ কাদের জামিরি ঢাকায় চলে এলে এবং বেনেপুকুর লেনের ১১ নম্বর বাড়িতে বসবাসকারী ওস্তাদ মুহম্মদ হোসেন খসরুর কাছেও তাঁরা তালিম নেন। বাবার কাছে তো শিখতেনই।
কলকাতাতেই মুস্তাফা জামান আব্বাসীর প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় এবং তা যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পায়। বাংলাদেশে দেবু ভট্টাচার্যের সুরে তিনি আধুনিক গান গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে অন্তত এক ডজন ছবিতে প্লেব্যাকও করেন। বাংলা গানের পাশাপাশি তিনি হিন্দি ও উর্দু গানেও ছিলেন সমান পারদর্শী, গেয়েছেন গজলও। ভারতবর্ষের গজলের কিংবদন্তি মেহেদি হাসানের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর সখ্য। পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় যখন মেহেদি হাসান অপরিচিত ও এয়ারফোর্সের এক সাধারণ চাকুরে, তখন আব্বাসীই তাঁকে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বন্ধুর গান শুনলে আজও তাঁর সেদিনের কথাই মনে পড়ত।
সংগীতকে কখনো পেশা হিসেবে না নিলেও, মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, মতিঝিলে ছিল তাঁর অফিস। কর্মজীবনের শুরুতে পাকিস্তানের একটি বড় কোম্পানিতে উচ্চপদেও আসীন ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যদিও মাত্র নয় মাস পর তিনি সেই পদ থেকে সরে আসেন। বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোকসংগীতের অনুষ্ঠান ‘বাঁশরী’ ও ‘হিজলতমাল’-এ তিনি পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গান করেছেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষের চিঠি পেতেন আব্বাসী। ছোট ছোট অনুভূতির প্রকাশ 담া সেই চিঠিগুলো তিনি সযত্নে আগলে রাখতেন, যা ছিল তাঁর জীবনের এক অমূল্য সঞ্চয়। কুচবিহার থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকার স্মৃতিবিজড়িত এই গুণী শিল্পী সেন্ট গ্রেগরিজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন, লেখাপড়ায় বরাবরই প্রথম হতেন। সেই স্কুলজীবনের মজার ঘটনাগুলো তাঁকে প্রায়শই নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করত।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর প্রয়াণে বাংলা সংগীত হারাল একনিষ্ঠ সাধক, গবেষক ও সুরের সত্যিকারের উত্তরাধিকারীকে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ, অমায়িক ব্যবহার আর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চিরকাল সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে।