১৮৮৯ সাল। শিকাগোর শ্রমিকদের রক্তে ভেজা স্মৃতি তখনও তাজা। দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন। কর্মঘন্টার আড়ালে ছিল শ্রমিকদের আরও একটা গভীর আকুতি– এমন মজুরি পাওয়া- যা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকা নয়, একটু মানবিক ভাবে বাঁচা যায়।
ইতিহাস বলে, সেই সময় বেশিরভাগ শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ছিল দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। মজুরি? আজকের হিসাবে তা ছিল হাস্যকর রকম কম, যা দিয়ে নুন- আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। পুষ্টি বা স্বাস্থ্যের কথা ভাবাটাও ছিল বিলাসিতা।
১৩৬ বছর পর, ২০২৫ সাল। বিশ্ব অর্থনীতি আকারে বেড়েছে বহুগুণ, প্রযুক্তি এনেছে বিপ্লব। কিন্তু যে শ্রমিকদের ঘামে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ, তাদের অবস্থা কতটা বদলেছে?
আসুন দেখি পরিসংখ্যান কী বলছে, বিশেষ করে আমাদের অঞ্চলে? বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানে?
কাগজে-কলমে কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে? সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক বা নির্মাণ খাতে, শ্রমিকদের প্রায়শই ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, যার ওভারটাইম হয় নামমাত্র, অনেক সময় থাকেই না। আইনত ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে। যেমন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২,৫০০ টাকায়। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে এবং পেশায় এই অঙ্ক ভিন্ন, গড়ে হয়তো দৈনিক ৩০০-৫০০ রুপি। পাকিস্তানেও মাসিক নূন্যতম মজুরি প্রায় ২৫,০০০-৩০,০০০ রুপি ।
১৩৬ বছর আগে আমেরিকার শ্রমিকদের ঘন্টাপ্রতি মজুরি ছিল গড়ে ৭৫ ডলার। সেই ১৩৬ বছর আগে যেই বেতন তারা পেতেন অনেক ক্ষেত্রে সেটা আজকের দিনে বাংলাদেশে একজন স্রমিকের বেতনের চাইতে বেশি।
শুনতে হয়তো অবিশ্বাস্য লাগবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঢাকা, দিল্লি বা করাচির মতো বড় শহরে ৪ সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক ন্যুনতম জীবনধারণ খরচের সাথে এই মজুরিকে তুলনা করলে অবাক হয়ে হয় যে কীভাবে এই শ্রমিকেরা বেঁচে আছেন?
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘লিভিং ওয়েজ’ বা মানবিক জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির হিসাব এই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক উঁচুতে।
আয় আর ব্যয়ের এই ফারাক আরও বাড়িয়ে দেয় লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কোথাও কোথাও খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির হার ১০%, ১৫% বা তারও বেশি ছুঁয়েছে। চাল, ডাল, তেল, আটা, পেঁয়াজ – নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ শ্রমিকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ, অনেক ক্ষেত্রেই মজুরি বৃদ্ধির হার মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম। এর মানে হলো, শ্রমিকের প্রকৃত আয় প্রতি বছর কমে যাচ্ছে।
এই আয়ের স্বল্পতা সরাসরি আঘাত হানে খাবারের পাতে। ১৮৮৯ সালের শ্রমিকের মতো আজও দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি শ্রমিকের খাবার মানে মূলত কার্বোহাইড্রেট – ভাত বা রুটি, সাথে সামান্য ডাল বা আলু।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের শিশুদের মধ্যে এখনও খর্বকায়তা এবং কম ওজনের হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
এর মূল কারণগুলোর একটি হলো পরিবারের অপর্যাপ্ত আয় এবং মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতা। পরিসংখ্যান বলছে, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের আয়ের ৫০% থেকে ৭০% পর্যন্ত খরচ করে শুধুমাত্র খাদ্যের পেছনে! যেখানে উন্নত বিশ্বে এই হার অনেক কম।
প্রোটিন বা আমিষের উৎস – মাছ, মাংস, ডিম, দুধ – তাদের কাছে বিলাসিতা। মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের হার এই দেশগুলোতে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশ কম, এবং আয়ের নিচের দিকের মানুষের জন্য তা আরও নগণ্য।
এই করুণ চিত্রের পাশেই রয়েছে বৈষম্যের এক বিশাল পাহাড়। অক্সফাম বা ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটাবেজের মতো সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে আয় বৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে উপরের ১০% মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের অর্ধেকেরও বেশি জমা, যেখানে নীচের ৫০% মানুষের ভাগে থাকে মাত্র ১৩-১৫%। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি একই রকম, ১০ ভাগ মানুষ ৯০ ভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
এই চরম বৈষম্য শ্রমিকের বঞ্চনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ১৮৮৯ সালের শোষণ হয়তো ছিল প্রত্যক্ষ, আজ তা আরও জটিল ও কাঠামোগত।
বিশ্বায়ন বা প্রযুক্তিগত উন্নতির সুফল নিচের তলার শ্রমিকদের কাছে প্রায় কিছুই পৌঁছায়ইনি।
শ্রমিক সংগঠনগুলো লড়ছে, কিছু আইনি সুরক্ষা এসেছে, সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান যে কঠিন সত্য তুলে ধরে তা হলো – ১৩৬ বছর পেরিয়ে এসেও মৌলিক চাহিদা পূরণের সংগ্রাম এতটুকু কমেনি বহু শ্রমিকের জীবনে। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি পূরণ হলেও, মানবিক মজুরি আর পুষ্টিকর খাবারের অধিকার আজও অধরা।
এই মে দিবসে, ইতিহাসের স্মরণের পাশাপাশি আসুন আমরা এই ডেটা আর পরিসংখ্যানগুলোও দেখি। কারণ এগুলো শুধু সংখ্যা নয়, এগুলো লক্ষ কোটি মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
১৮৮৯ থেকে ২০২৫ – কতটা পথ পেরোলাম আর কতটা বাকি, সেই আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি।
কারণ, পরিসংখ্যান যখন বলে দেশের জিডিপি বাড়ছে, তখন প্রশ্ন করতে হবে – সেই প্রবৃদ্ধির সুফল শ্রমিকের পাত পর্যন্ত কতোটা পৌঁছাচ্ছে?


