কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার হাতের স্মার্টফোনটি শুধু যোগাযোগেরই মাধ্যম নয় বরং আপনার মস্তিষ্কের ভেতরেও ঘটিয়ে চলেছে নানান পরিবর্তন? হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। আধুনিক জীবনের এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং এমনকি মস্তিষ্কের মৌলিক গঠনকেও প্রভাবিত করছে। আসুন, এই বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরভাবে আলাপ করা যাক।
প্রথমেই আসা যাক মনোযোগ কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে। স্মার্টফোনের ক্রমাগত নোটিফিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণ আর মাল্টিটাস্কিংয়ের প্রবণতা আমাদের মনোযোগকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘন ঘন ডিভাইস পরিবর্তন বা বিভিন্ন অ্যাপে সুইচ করার ফলে আমাদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যা মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দায়ী, তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। ফলে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যাকে অনেকে “ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া”-র প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবেও দেখছেন। আমরা তথ্য মনে রাখার চেয়ে স্মার্টফোনে তা খুঁজে বের করতে বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, যা আমাদের স্মরণশক্তিকেও দুর্বল করে দিতে পারে।
এরপরেই আসে ডোপামিন চক্রের কথা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্মার্টফোনে প্রতিটি লাইক, কমেন্ট বা নতুন নোটিফিকেশন আমাদের মস্তিষ্কে অল্প পরিমাণে ডোপামিন নিঃসরণ করে। এই ডোপামিন হলো এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যা আমাদের আনন্দ ও পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি দেয়। স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে এই অনুভূতি বারবার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, যা এক ধরনের আসক্তির জন্ম দেয়। এই “রিওয়ার্ড লুপ” বা পুরস্কার চক্রের কারণে আমরা বারবার ফোন চেক করতে বাধ্য হই, যা আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ডোপামিন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি আমাদের মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের বাহ্যিকভাবে চাকচিক্যপূর্ণ জীবনযাত্রা দেখে নিজের জীবনের প্রতি অসন্তোষ, ঈর্ষা এবং হীনম্মন্যতা তৈরি হতে পারে। এই ধরনের নেতিবাচক আবেগ মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামক অংশকে অতি সক্রিয় করে তোলে, যা ভয় ও উদ্বেগের কেন্দ্র। ফলস্বরূপ, মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তরুণদের মধ্যে বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সবশেষে, ঘুমের সমস্যার কথা না বললেই নয়। স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নামক হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। এই মেলাটোনিন আমাদের ঘুমের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, রাতে দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহারে ঘুমের গুণমান নষ্ট হয়, অনিদ্রা দেখা দেয়। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্কের কগনিটিভ ফাংশন, যেমন – স্মৃতিশক্তি, সমস্যা সমাধান এবং সৃজনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, স্মার্টফোন পুরোপুরি বর্জনীয়। বরং এর নিয়ন্ত্রিত ও সচেতন ব্যবহারই কাম্য। আমাদের বুঝতে হবে, এই প্রযুক্তি আমাদের উপকারের জন্য তৈরি হয়েছে, ক্ষতির জন্য নয়। তাই, ডিজিটাল ওয়েলবিইং বা প্রযুক্তির সুষম ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমাদের মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রেখে সুস্থ থাকতে পারে।


