আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায় শেখ হাসিনার পরিচয়কেই= বদলে দিয়েছে। তিনি এখন আর কেবল একজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী নন, বাংলাদেশের চোখে তিনি একজন দণ্ডিত ও পলাতক অপরাধী।
এই নতুন পরিচয় ভারতের জন্য এক তীব্র অস্বস্তি তৈরি করেছে এবং একটি জরুরি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—শেখ হাসিনা আর কতদিন ভারতে থাকতে পারবেন? নয়াদিল্লি কি তাকে দ্রুত দেশ ছাড়তে বলবে?
–
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসকদের নির্বাসনের অভিজ্ঞতা বিচিত্র।
ইরানের শাহ ক্ষমতা হারানোর পর কোনো দেশেই স্থায়ী আশ্রয় পাননি; এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে অবশেষে মিশরে মৃত্যুবরণ করেন।
উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন সৌদি আরবে একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন, কারণ ভূরাজনৈতিক সমীকরণে তিনি রিয়াদের জন্য আর কোনো হুমকি ছিলেন না।
এই ঘটনাগুলো থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট: একজন ক্ষমতাচ্যুত নেতার নির্বাসনের মেয়াদ নির্ভর করে আশ্রয়দাতা দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ওপর, কোনো মানবিক বা আইনি নীতির ওপর নয়।
–
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই ভূরাজনৈতিক স্বার্থের হিসাবটি অত্যন্ত জটিল। ভারত তাকে দ্রুত দেশ ছাড়তে বলবে, এমন সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ শেখ হাসিনা ভারতের জন্য কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি কৌশলগত বিনিয়োগের প্রতীক।
দেড় দশক ধরে তিনি ভারতের যে নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করেছেন, নয়াদিল্লি তা এক মুহূর্তে ভুলে যাবে না। তাকে আশ্রয় দিয়ে যাওয়া ভারতের জন্য একটি বার্তা—তারা তাদের বিশ্বস্ত মিত্রদের বিপদের দিনে পরিত্যাগ করে না। এই বিশ্বাসযোগ্যতা ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
সুতরাং, যা ঘটতে পারে তা হলো, ভারত শেখ হাসিনাকে একটি ‘সোনালি খাঁচায়’ রাখবে। তাকে সব ধরনের নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়া হবে, কিন্তু তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থাকবে কড়া নজরদারি।
ভারত থেকে তিনি যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারেন বা কোনো উসকানিমূলক বিবৃতি দিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করবে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, তার ভারতে থাকাটা হবে শর্তসাপেক্ষ এবং দীর্ঘমেয়াদী, যদিনা তিনি ভারতের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বোঝায় পরিণত হন।
–
তবে এই রায়ের পর শেখ হাসিনার জন্য বাকি বিশ্বের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য দেশগুলোতে—যেমন ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, কানাডা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে—ভ্রমণ করা তার জন্য অসম্ভব।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হওয়ায়, এই দেশগুলোর মাটিতে পা রাখা মাত্রই তাকে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি তৈরি হবে।
কিছু দেশ যারা আইসিসির আওতার বাইরে, যেমন চীন, রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ, সাময়িকভাবে তাকে আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে জটিলতা।
চীন বা রাশিয়া তাকে আশ্রয় দিলে তা হবে ভারতের প্রতি একটি সরাসরি ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা তারা এড়াতে চাইবে।
–
শেষ পর্যন্ত, শেখ হাসিনার জন্য ভারতই সবচেয়ে নিরাপদ এবং সম্ভবত একমাত্র টেকসই আশ্রয়স্থল। রায় ঘোষণার পর ভারতের ওপর কৈফিয়তের চাপ বাড়বে, অস্বস্তিও থাকবে, কিন্তু কৌশলগত বাধ্যবাধকতার কারণে তারা তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে না। তাই, তাকে দ্রুত ভারত ছাড়তে হবে—এমনটা ভাবার কারণ নেই। বরং বলা যায়, এই রায়ের পর তার পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে এবং ভারতই হয়ে উঠেছে তার শেষ ঠিকানা।


