আপনি কি জানেন? প্রকৃতিতে এমন কিছু প্রাণী আছে যাদের যৌনমিলন শুধু বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া নয়, বরং অপর সঙ্গীর জীবনের শেষ মুহূর্তও বটে! হ্যাঁ, যৌনমিলনের পর সঙ্গীকে খেয়ে ফেলার মতো অদ্ভূত অথচ বাস্তব ঘটনার উদাহরণ প্রাণীজগতে আছে, যা ‘সেক্সুয়াল ক্যানিবালিজম’ নামে পরিচিত।
এই আচরণের অন্যতম উদাহরণ হলো ব্ল্যাক উইডো মাকড়সা। স্ত্রী ব্ল্যাক উইডো মাকড়সা পুরুষ সঙ্গীর চেয়ে আকারে বেশ বড় এবং শক্তিশালী হয়। মিলনের পর, বা অনেক সময় মিলনের সময়েই, স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাটিকে খেয়ে ফেলে। আপাতদৃষ্টিতে এটি নিষ্ঠুর মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে বিবর্তনের সুনির্দিষ্ট কারণ। পুরুষ মাকড়সাটি তার জীবন দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পুষ্টি জুগিয়ে যায়। এই অতিরিক্ত পুষ্টি স্ত্রী মাকড়সাকে আরও বেশি স্বাস্থ্যবান ও ডিম পাড়তে সাহায্য করে, যা প্রকারান্তরে পুরুষ মাকড়সাটির জিনগত উত্তরাধিকারকেই নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, পুরুষ মাকড়সাটি নিজের জীবন দিয়ে তার জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায় Praying Mantis বা পাতাফড়িংয়ের কিছু প্রজাতির মধ্যে। স্ত্রী ম্যান্টিসও পুরুষ সঙ্গীর তুলনায় বড় ও হিংস্র হয়। এখানেও মিলনের পর স্ত্রী ম্যান্টিস পুরুষটিকে খেয়ে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পুরুষ ম্যান্টিসের মাথা বিচ্ছিন্ন করার পরও তার দেহ মিলন প্রক্রিয়া সচল রাখতে পারে! এর কারণ, ম্যান্টিসের প্রজনন অঙ্গের স্নায়ুবিক নিয়ন্ত্রণ তার পেটের দিকের স্নায়ুগ্রন্থি থেকে হয়, মাথার মস্তিষ্ক থেকে নয়। এখানেও মূল উদ্দেশ্য পুষ্টি সংগ্রহ এবং সেই পুষ্টিকে ডিমের বিকাশে কাজে লাগানো। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যে স্ত্রী ম্যান্টিস পুরুষ সঙ্গীকে খায়, সে তুলনামূলকভাবে বেশি ডিম পাড়ে।
কিন্তু কেন এই অদ্ভুত আচরণ? বিজ্ঞানীরা এর পেছনে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমত, ‘নিউট্রিশনাল গেইন হাইপোথিসিস’ বা পুষ্টি লাভের তত্ত্বটি সর্বাধিক স্বীকৃত। সঙ্গীকে ভক্ষণ করার মাধ্যমে স্ত্রী প্রাণীটি প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও অন্যান্য জরুরি পুষ্টি উপাদান পায়, যা তার ডিম্বাণু উৎপাদন এবং ডিমের গুণগত মান বৃদ্ধিতে সরাসরি সাহায্য করে। ফলে, পরবর্তী প্রজন্মের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ প্রাণীটির পালানোর সুযোগ কম থাকে, বিশেষত যখন স্ত্রী প্রাণীটি আকারে অনেক বড় এবং আগ্রাসী হয়। আবার, কোনো কোনো প্রজাতিতে পুরুষ প্রাণী স্বেচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করে, যেন তার জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মে সফলভাবে স্থানান্তরিত হতে পারে। এটি এক চরম ‘প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট’-এর উদাহরণ, যেখানে পুরুষটি তার দেহাংশকেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে। এছাড়াও, ‘অ্যাগ্রেসিভ স্পিলওভার হাইপোথিসিস’ অনুযায়ী, স্ত্রী প্রাণীর সাধারণ শিকারি প্রবৃত্তির বর্ধিত প্রকাশ হিসেবেও এই আচরণ দেখা যেতে পারে।
অর্থাৎ বোঝা গেলো যৌনমিলনের পর সঙ্গীকে খেয়ে ফেলার এই ঘটনা প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা নয় বরং টিকে থাকার লড়াইয়ে বিবর্তিত হওয়া এক জটিল অভিযোজন প্রক্রিয়া।