এই কাওয়ালি গানটি শুধু পাকিস্তানের সিন্ধু কিংবা ভারতের পাঞ্জাবেই নয়, বাংলাদেশেও একই আবেগে গাওয়া হয়। এর পেছনের ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি গানটি হয়ে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের এক সুরেলা দলিল।
গানের সূত্রপাত পাকিস্তানের সেহওয়ান শরিফ অঞ্চলে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক জিপসি কিশোরী হঠাৎ করেই বাজারে উর্দু-পাঞ্জাবি মিশ্রণে গেয়ে উঠেছিল একটি গান। রেডিও পাকিস্তানের এক ঘূর্ণায়মান রেকর্ডিং টিম সেই গানটি রেকর্ড করে নেয়। তারপর থেকেই “মাস্ত কালান্দার” হয়ে ওঠে জনপ্রিয়তার মুকুটহীন সম্রাট।
ওই জিপসি মেয়েটির কথা কেউ আর পরে শোনেনি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া গান ছড়িয়ে পড়ে ভারতের দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও।
এই গানের শিকড় খুঁজতে গেলে চলে যেতে হয় ১৩শ শতকের সুফি কবি আমীর খসরুর কাছে। তাঁর এক প্রার্থনার সুরেই সম্ভবত “মাস্ত কালান্দার”-এর আদিরূপ। পরবর্তী সময়ে বুল্লে শাহ এই গানে যুক্ত করেন তাঁর পীর শাহবাজ কালান্দারের বন্দনা।
নুসরাত ফতেহ আলী খান, সাবরি ব্রাদার্স, রুনা লায়লা, কৈলাস খেরসহ বহু কিংবদন্তি শিল্পীর কণ্ঠে গানটি পেয়েছে নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ।
লালবাবা শাহবাজ কালান্দার, যাঁর আসল নাম সৈয়দ মুহাম্মদ উসমান মারওয়ান্দি, ছিলেন ১১শ শতকের সুফি সাধক। তাঁর “শাহবাজ” উপাধি আসে আধ্যাত্মিক উঁচুতা ও মুক্তপাখির মতো অবাধ চেতনার প্রতীক হয়ে। “কালান্দার” উপাধি নির্দেশ করে দুনিয়াবি মোহের ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী চিরকুমার ফকিরদের।
তিনি ছিলেন হযরত আলীর বংশধর এবং ইরাকের মারওয়ান্দে জন্মগ্রহণ করেন। মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে দেশ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে এসে তিনি সুফি চেতনার শিকড় গেড়ে দেন সিন্ধ অঞ্চলে।
এই গানের আরেকটি নাম “ঝুলেলাল”— সিন্ধু হিন্দুদের মতে, এই ঝুলেলাল হলেন বরুণদেবের অবতার, যিনি একবার মাছের পিঠে চড়ে সিন্ধু পার হন! আবার মুসলমানদের কাছে তিনি হলেন শাহবাজ কালান্দার। এখানে এসে দুই ধর্মের আখ্যান মিলে যায় এক অলৌকিক মানবমূর্তিতে।
হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, মিরখ শাহ নামের এক ধর্মান্ধ শাসকের হাত থেকে রক্ষা পেতে বরুণ ঝুলেলাল রূপে অবতীর্ণ হন। তিনি ঘোষণা দেন, ধর্মবিশ্বাসে সবার সমান অধিকার রয়েছে।
গানে “আলীদা পেহেলা নাম্বার” বলা হয়— অর্থাৎ প্রথম স্থান আলীর। কারণ ইসলামের ইতিহাসে হযরত আলী ছিলেন সর্বপ্রথম যিনি নবীকে অনুসরণ করেন। সুফিদের মতে, তিনিই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের উৎস।
“মাস্ত” শব্দটি এই গানে বারবার ফিরে আসে— যার মানে আধ্যাত্মিক উচ্ছ্বাসে মাতাল হওয়া, নিজের সত্তাকে প্রেমে বিলিয়ে দেওয়া।
২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাজ কালান্দারের মাজারে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলায় ৮৮ জন নিহত হন, যাদের ২১ জনই শিশু। পরদিন ভোরে মাজারের খাদেম প্রতিদিনের মতো ঘণ্টা বাজিয়ে ঘোষণা করেন: “আমরা সন্ত্রাসীদের সামনে মাথা নত করবো না।” সেই মুহূর্তেই শাহবাজ কালান্দার হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের প্রতীক।
“মাস্ত কালান্দার” গানটি শুধু একটি কাওয়ালি নয়, এটি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ— তিন দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির ঐক্য ও সহাবস্থানের একটি প্রতীক। গানে যেমন আছে বরুণদেব, তেমনি আছেন হযরত আলীর মাহাত্ম্য।
এই গানটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতি, ধর্ম, রাজনীতির বিভেদ অতিক্রম করে মানুষ কিভাবে ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা এবং গান দিয়ে এক হতে পারে।


