ভারত ও পাকিস্তান—দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এই দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, সীমান্ত উত্তেজনা এবং পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস দীর্ঘ সাত দশক ধরে চলমান। আজকের সত্তুর বছরে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলাপ করবো।
প্রথম যুদ্ধ: ১৯৪৭
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। বিভক্তির সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান তা মেনে নেয়নি। এর পরপরই ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় এক বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এ সময় কাশ্মীরকে দুটি অংশে বিভক্ত করে নিয়ন্ত্রণরেখা নির্ধারণ করা হয়।
১৯৬৫: দ্বিতীয় যুদ্ধ
প্রায় দুই দশক পর, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আবারও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এ ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থল এবং বিমান যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই সংঘর্ষের অবসান ঘটে।
তাশখন্দ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
১৯৭১: তৃতীয় যুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ এক নতুন মাত্রা পায়। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পটভূমিতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করলে প্রায় দুই সপ্তাহের যুদ্ধের পর পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৯৯: কার্গিল যুদ্ধ
১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের কার্গিল অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং সশস্ত্র যোদ্ধারা অনুপ্রবেশ করলে আবারও যুদ্ধ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ ছিল পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে প্রথম বড় আকারের সংঘর্ষ। ভারতীয় সেনাবাহিনী কার্গিল এলাকা পুনরুদ্ধার করে। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেই প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। আন্তর্জাতিক মহলে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়, যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
২০১৬ সালে উরি হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়, যা ছিল সীমান্তের ওপারে জঙ্গি ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে।
এরপর ২০১৯ সালে পুলাওয়ামা বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হলে, ভারত প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানের বালাকোটে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও বিমান হামলা চালায়, যা কার্গিল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করে।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল সংঘটিত সশস্ত্র হামলার জেরে ৭ মে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযানের পর পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালিয়ে কার্যত শুরু করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র, উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছাড়া উত্তেজনা প্রশমনের অন্য কোনো কার্যকর পথ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের সম্ভাব্যতা এবং তার পরিণতি বিবেচনায় নিয়ে, এখনই সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ শুরু করার।


