Homeতরুণজুবিন গার্গ - এক মাতাল সার্কাসম্যানের বিদায়

জুবিন গার্গ – এক মাতাল সার্কাসম্যানের বিদায়

Date:

অপ্রকৃতিস্থ জুবিন গার্গ। টলমল অবস্থায় মঞ্চে উঠছেন ,বেসুরো গাইছেন, গিটারে এলোমেলো হাত চলছে । এই ধরনের একাধিক ভিডিও গত কয়েক বছরে ভাইরাল হয়েছে। সেই পোস্টে কেউ কমেন্ট করছেন: কী করুণ পরিণতি । কেউ লিখছেন: দেখে খুব খারাপ লাগছে । আর অনেক অনেক মানুষ কটু কথা লিখেছেন, যেমন লেখেন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পোস্টে । দুঃখের বিষয় এঁরা বেশিরভাগ বাঙালি । তারা কেউ জানতেন না জুবিন কী জিনিস । আমিও জানতাম না। আসলে বাঙালি এখন আইকনশূন্য । নিভে যাওয়া শেষ প্রদীপ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । তাই আইকন বিষয়টা কী, এই মুহূর্তে বাঙালি সেটা বোঝে কম । জুবিন ব্যাডবয় জুবিন আইকন , সেই “ব্যাডবয় জুবিন” মারা গেছেন। তো তাতে কি হয়েছে? কিছু একটাতো হয়েছেই…
জুবিন গার্গ সিংগাপুরের সমুদ্রে স্কুবা করতে গিয়ে মারা যান । কিভাবে মারা গেছেন সেটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও, ধারণা করা যাচ্ছে যে, উনি হার্ট এ্যাটাক করেছেন।

এরপরই উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় সব রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গুয়াহাটি থেকে আগরতলা কিংবা অরুণাচল প্রদেশের ঘরে ঘরে দুই দিন ধরে শোকের মাতম চলছে! জুবিনের কফিন যখন গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে বের করা হয়, এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয়। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। জুবিনের নাম ধরে মাতম করছে, প্রায় পাগলের মত বিলাপ করছে! কারো হাতে ফুল, কেউ এনেছে বিরাট ছবি। নারীরা জুবিনের কফিনে রঙিন কাপড়ের টুকরো বিছিয়ে দিচ্ছে, এটি আসামের মৃতব্যক্তির প্রতি শোক প্রকাশের ঐতিহ্যের অংশ। গোটা শহর অচল হয়ে গেছে, ট্রাফিক ব্যবস্থা বলে কিছু অবশিষ্ট নাই। কফিনের সাথে সাথে লাখ লাখ মানুষ হাঁটছে। হাঁটছে ওখানকার পুলিশ প্রধান, মুখ্যমন্ত্রী…জুবিনের মৃত্যুতে অসমে প্রায় রাষ্ট্রীয় শোক। গত দুদিন ধরে সব স্তব্ধ ।

শোকে মানুষ এতটাই বিহ্বল যে সুইগি, জোমাটো-সহ সমস্ত অ্যাপ সার্ভিস বন্ধ রাখতে হয়েছে। কেন? কী এমন করেছেন জুবিন? আসলে, কিছু মানুষ সত্যিই ঈশ্বরের আপন সন্তান হন । যেমন জুবিন । ঠিক কী কারণে আবালবৃদ্ধবনিতার কাছের মানুষ ছিলেন তিনি কেউ জানে না । কেন ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জুবিনকে সবাই ভালোবাসতেন, কেউ জানেনা । কিন্তু বাসতেন। সবাই জুবিনকে ভালোবাসতেন। জুবিন এমন একজন ছিলেন, যাঁর কফিন কাঁধে নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গান গাইছেন । যাঁর মৃত্যুতে অসমের ডিজিপি নিজে রাস্তায় নেমে ভিড় সামলাচ্ছেন । পুলিশকর্মীরা হাউ হাউ করে কাঁদছেন।

জুবিন এমন একজন ছিলেন যিনি বিহুর সময়ও মঞ্চে হিন্দি গান গাইতেন । যেখানে ULFA ফতোয়া জারি করেছিল যে বিহুর সময় অসমে কেবল অহমিয়া গান চলবে । জুবিনকে ULFA-ও চ্যাতাতো না। জুবিন এমন একজন ছিলেন যিনি সারারাত সারাদিন মদ খেতেন । মঞ্চে উঠে উল্টোপালটা গাইতেন। মঞ্চে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়েও পড়তেন । যাকে তাকে গালাগালি করতেন। যাঁর মুখে কিছু আটকাত না। অথচ সবার জন্য জুবিনের কাছে ছিল অবারিত দ্বার। সবাই জুবিনের সব দোষ ক্ষমা করে দিতেন। যিনি CAA ও NRC বিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। যিনি এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সরকারবিরোধী বক্তব্য রাখতে পিছপা হননি। আসলে জুবিন কী ছিলেন, কেন জুবিনকে নিয়ে এত উন্মাদনা, তার কোনও উত্তর নেই । কেন জুবিনের মৃত্যুতে সুদূর অরুণাচল প্রদেশের গলিতে গলিতে তাঁর ছবি সাজিয়ে মানুষ প্রার্থনা করছেন ; কেন তাঁর শেষযাত্রায় অংশ নিতে লাখো মানুষ কান্নাকাটি করে রাস্তায় নেমেছেন; কেন তাঁর কফিন একবার ছুঁয়ে দেখতে মানুষ এত পাগলের মতো রাস্তায় ছুটছেন;

আসলে বৃষ্টির দিন উপেক্ষা করে হুমায়ূন আহমেদের মত এক “মামুলি লেখকের” কফিনে একটা ফুল দেওয়ার জন্য কেনো শহীদ মিনার থেকে লাইন দীর্ঘ হতে হতে পলাশীর মোড় ছাড়িয়ে যায়? কেনো উত্তম কুমারের কফিনের পেছনে গোটা কলকাতা শহর স্তব্ধ হয়ে হাঁটে? এই কি তবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তি? “গান বাজনার” পাওয়ার? আমরা জানিনা। আমরা জানি না, বুঝি না। পারবও না। সম্ভবত: সবকিছু জানার অধিকার মানুষকে দেয়া হয় নাই আসলে, সম্ভবত কিছু মানুষ সত্যিই ঈশ্বরের আপন সন্তান , প্রকৃতির সন্তান হন ,যেমন জুবিন । আসলে মানুষের জন্য একবার দাড়ালে মানুষ ভুলে না, মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ এখনও হয়নি, প্রকৃতির নিষেধাজ্ঞা আছে… বিদায় জুবিন দেখা হবে …। আবার

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক