Homeবিজ্ঞানকীভাবে গান আমাদের মস্তিষ্ক ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে?

কীভাবে গান আমাদের মস্তিষ্ক ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে?

Date:

সঙ্গীত এক আশ্চর্য শক্তি; যা ভাষার সীমানা পেরিয়ে আমাদের আত্মার গভীরে স্পর্শ করতে পারে। আনন্দ, দুঃখ, উত্তেজনা বা প্রশান্তি – সুরের ইন্দ্রজালে মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে আমাদের মনের অবস্থা। কিন্তু কীভাবে এই সুরতরঙ্গ আমাদের মস্তিষ্ক আর আবেগের গভীরে এমন আলোড়ন তোলে? বিজ্ঞান এই রহস্যের অনেকটাই উন্মোচন করেছে, আর আজ আমাদের যাত্রা সেই পথেই ।

প্রথমেই আসা যাক ডোপামিন নিঃসরণের প্রসঙ্গে। যখন আমরা প্রিয় কোনও গান শুনি কিংবা কোনও সুর আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলে যায়, তখন ব্রেইনের রিওয়ার্ড সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়। এই ডোপামিন আমাদের আনন্দের অনুভূতি দেয়, মনকে সুখী করে তোলে। ঠিক যেমন সুস্বাদু খাবার বা কোনও পুরস্কার পেলে আমাদের ভালো লাগে, সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও ব্রেইনের একই অংশ উদ্দীপ্ত হয়। প্রত্যাশা এবং তা পূরণের যে আনন্দ, সঙ্গীত তা নিপুণভাবে জাগিয়ে তুলতে পারে, যা আমাদের বারবার সেই সুরের কাছে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে।

স্মৃতি ও সঙ্গীতের সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর। অনেক সময়ই একটি বিশেষ গান আমাদের অতীতের কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা বা অনুভূতির কথা মনে করিয়ে দেয়। এর কারণ হলো, মস্তিষ্ক যখন সঙ্গীতের সুর ও তাল প্রক্রিয়াকরণ করে, তখন স্মৃতির সঙ্গে জড়িত অংশগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে। হিপ্পোক্যাম্পাস, যা স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা সঙ্গীতের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই কারণেই হয়তো কোনও পুরনো গান শুনলে আচমকা শৈশবের কোনও বন্ধু বা কৈশোরের কোনও বিশেষ দিনের কথা vividly মনে পড়ে যায়, যেন সেই মুহূর্তটিতে আমরা ফিরে গিয়েছি।

সঙ্গীতের এই স্মৃতি-জাগানিয়া ক্ষমতা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের বৈশিষ্ট্য একে এক শক্তিশালী থেরাপিউটিক উপকরণে পরিণত করেছে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ কমানো থেকে শুরু করে বিষণ্ণতা মোকাবিলাতেও সঙ্গীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষত, ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারসের মতো স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সঙ্গীত থেরাপি আশার আলো দেখিয়েছে। পুরনো দিনের পরিচিত গান অনেক সময়েই তাদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে এবং সাময়িকভাবে হলেও তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও সঙ্গীত ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মস্তিষ্কের তরঙ্গ বা ব্রেইনওয়েভের উপরেও সঙ্গীতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমাদের ব্রেইন বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি করে, যেমন আলফা, বিটা, থিটা ও ডেল্টা। শান্ত, ধীর লয়ের সঙ্গীত, যেমন ক্লাসিক্যাল বা অ্যাম্বিয়েন্ট মিউজিক, মস্তিষ্কের আলফা তরঙ্গকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা আমাদের রিল্যাক্সড ও প্রশান্ত বোধ করায়। অন্যদিকে, দ্রুত লয়ের উদ্দীপক সঙ্গীত বিটা তরঙ্গের প্রাধান্য ঘটিয়ে মনোযোগ ও সতর্কতা বাড়াতে সাহায্য করে। যোগ বা ধ্যান করার সময়ে যে বিশেষ ধরনের সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়, তা থিটা তরঙ্গকে উদ্দীপ্ত করে গভীর শিথিলতা ও সৃজনশীলতা বাড়াতে পারে।

বিভিন্ন সুর ও তার প্রকারভেদ আমাদের মনে বিভিন্ন আবেগের জন্ম দেয়। সাধারণত মেজর স্কেলের সুর আনন্দ বা উচ্ছ্বাসের অনুভূতি জাগায়, অন্যদিকে মাইনর স্কেলের সুর বিষণ্ণতা বা গভীর চিন্তার উদ্রেক করে। গানের লয় বা টেম্পোও গুরুত্বপূর্ণ; দ্রুত লয়ের সঙ্গীত যেমন আমাদের উত্তেজিত করে তোলে, তেমনি ধীরস্থির সুর আনে প্রশান্তি। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, সুরের জটিলতা এবং গানের কথার সম্মিলিত প্রভাবে একটি সঙ্গীত আমাদের আবেগিক অভিজ্ঞতাকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কোনও কোনও সুর আমাদের শরীরে কাঁটা দেয়, আবার কোনও সুর চোখ ভিজিয়ে দেয় অজান্তেই।

সঙ্গীতের এই রহস্যময় অথচ শক্তিশালী প্রভাব আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা মানব সভ্যতাকে আদিকাল থেকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।

আরও পড়ুন

স্বপ্ন দেখি কেন? জানুন ঘুম, মস্তিষ্ক ও আবেগের রহস্যময় সংযোগ

আচ্ছা, আমরা স্বপ্ন দেখি কেন? এই প্রশ্নটা বোধহয় মানব...

সঙ্গীত কীভাবে মস্তিষ্ক, আবেগ আর স্মৃতিকে প্রভাবিত করে – জানুন বিজ্ঞানের চোখে

সঙ্গীত এক আশ্চর্য শক্তি; যা ভাষার সীমানা পেরিয়ে আমাদের...

আমরা কি আমাদের ব্রেইনের মাত্র ১০% ব্যবহার করি?

আপনিও কি এই বহুল প্রচলিত কথাটা শুনেছেন – আমরা...

স্মার্টফোন যেভাবে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন করছে

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার হাতের স্মার্টফোনটি শুধু যোগাযোগেরই...

মানবদেহের ভেতরের গোপন বিস্ময়: যা আমরা অনেকেই জানি না

প্রথমেই কথা বলা যাক শরীরের ইলেকট্রিসিটি নিয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই...

সাম্প্রতিক